ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ঈশ্বরদীতে ১১ হাজার ২৫৮ বাগানে ১৭২ কোটি লিচু!

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২
ঈশ্বরদীতে ১১ হাজার ২৫৮ বাগানে ১৭২ কোটি লিচু!

পাবনা (ঈশ্বরদী): লিচু ভাণ্ডারখ্যাত হিসেবে দেশজুড়ে ঈশ্বরদীর সুমিষ্ট রসালো লিচুর বেশ কদর রয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলাতে ৩ হাজার ১শ হেক্টর জমির ১১ হাজার ২৫৮ বাগানে ৮ হাজার কৃষক লিচু আবাদ করেছেন।

এসব বাগানে এবার মিলবে ১৭১ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার সুস্বাদু রসালো লিচু।  

বর্তমানে লিচুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে পাকা লিচু। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন লিচু চাষি ও বাগান মালিকরা। কৃষক ও কৃষিবিভাগ আশা করছে, লিচু উৎপাদন চলতি বছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।  

লিচু চাষি আর স্থানীয় কৃষিবিভাগের অনুমান, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২৫৫ কোটি বেশি অর্থাৎ ৬০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।  

সোমবার (২৩ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঈশ্বরদী উপজেলার লিচুগ্রাম হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন লিচুর বাগান ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি প্রতি হাজার লিচু আকারভেদে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। লিচুর দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  

এ বছরে ৯০ শতাংশ লিচুর জমিতে বাম্পার ফলনে ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮০টি গাছে গড়ে সাড়ে ৫ হাজার লিচু ধরেছে। যদি পাইকারিতে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার-আড়াই হাজার টাকায় লিচু বিক্রি করা যায়, লিচু চাষি ও স্থানীয় কৃষি বিভাগের অনুমান প্রায় ৬০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করা সম্ভব হবে।  

ঈশ্বরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আবাদ হয়েছে সুমিষ্ট লিচু। জৈষ্ঠ্যের শুরুতে মোজাফফর (দেশি) জাতের লিচু টক তবে পরিপক্ব হলে বেশ মিষ্টি বলে অল্প হয় চাষ। বোম্বাই ও চায়না-৩ জাতের লিচুর আঁটি সাধারণত আকারে ছোট, রসালো, মাংসল এবং বেশ সুগন্ধ বলে এলাকাজুড়ে এই লিচুর আবাদ ও চাষিদের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। মধু মাস জৈষ্ঠ্যের শুরুতে গাছে গাছে ঝুলছে লাল লিচু। এ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত গাছে থাকবে লিচু।

চলতি বছরে উপজেলায় লিচু গাছের মুকুল আসা থেকে শুরু করে গুঁটি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি গাছে লিচু আসা, ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় খুশি স্থানীয় লিচু চাষি ও বাগান মালিকরা।  

ঈশ্বরদী উপজেলার সব ইউনিয়নেই লিচুর চাষ হয়। সলিমপুর, সাঁহাপুর, পাকশী ইউনিয়নজুড়ে মাঠের পর মাঠ শুধুই লিচু। এছাড়া দাশুড়িয়া, লক্ষ্মীকুন্ডা, সাঁড়া ইউনিয়নে কমবেশি দেখা যায়। প্রতি ১ হেক্টর জমিতে ১৫টি লিচু গাছ লাগানো হয়ে থাকে। ৫ বছর পর কৃষকের পরিশ্রম স্বার্থক হয় অর্থাৎ গাছে মুকুল আসা শুরু করে। চলতি অর্থবছরে ফলন্ত লিচু আবাদী জমির পরিমাণ ২ হাজার ৭৯০ হেক্টর।

ঈশ্বরদী-পাকশী আঞ্চলিক সড়কের বাঘইলের সৌখিন চাষি রবিউল ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। বাবার পৈতৃক জমিতে বড় ভাই, কৃষক রেজাউল করিম রেজাকে সঙ্গে নিয়ে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে লিচুর আবাদ করেছেন। বাগানে ৪৭টি গাছের মধ্যে ৪২টি গাছে লিচুর বাম্পার ফলন পেয়েছেন। গায়ে খাটুনি সার-কীটনাশক বাবদ খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। লিচু বিক্রি থেকে আয় হবে খরচ ছাড়াই ৩ লাখ টাকা।

লিচু চাষি রেজাউল করিম বাংলানিউজকে জানান, বাগান থেকে লিচু সংগ্রহ করা হচ্ছে। লিচু পাড়ার পর দুই ভাগ করা হয়। লিচুর আকারভেদে যেগুলো বড় সেগুলো ২ হাজার ২শ টাকা হাজার। সেগুলো ঝুড়িতে, কার্টনে দেশের অন্তত ৩০ জেলায় পাঠানো হচ্ছে। আর আকারে ছোট লিচু স্থানীয় ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে ১ হাজার ৮শ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।  

ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের চর-রূপপুর গ্রামে শিক্ষিত যুবক পলাশ আহম্মেদ। পড়ালেখা শেষ করলেও চাকরি পাননি। শেষে বাবার পৈতৃক জমিতে লিচু চাষ করছেন কয়েক বছর থেকে।  

কৃষক পলাশ আহম্মেদ (৪৫) বাংলানিউজকে জানান, আমি একটু ব্যতিক্রমভাবে লিচুর আবাদ করেছি। আমার বাগান থেকে মধু সংগ্রহ করেন মৌয়াল চাষিরা। এতে লিচু বাগানে লিচুর মুকুলে পরাগায়ন সৃষ্টি হয়। যে বাগান থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়, ওই বাগানে লিচুর বাম্পার ফলন হয়। এছাড়া খুব দরকার ছাড়া কীটনাশক সার ব্যবহার করা হয়নি। জমি পরিচর্যা ও দেশি কম্পোস্ট সার ব্যবহারে ফলন ভালো হয়, আবার রোগবালাই কম হয়। আমাদের ১৮ বিঘা জমিতে ২১৬টি গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি গড়ে ৬ হাজারের বেশি লিচু ধরেছে। দেশি লিচুর পরিমাণ ছিল একবারে কম। বোম্বাই, চায়না-৩ জাতের লিচু আবাদে পরিচর্যা, সার-কীটনাশক বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। আবহাওয়া এবার অনুকূলে ছিল বলে বাম্পার ফলন হয়েছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ অর্থাৎ জৈষ্ঠ্যের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে খরচ বাদে ৭ লাখ টাকা লিচু চাষে আয় হবে।   

ঈশ্বরদী উপজেলার (অতিরিক্ত) কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা মোতমাইন্না বাংলানিউজকে জানান, ঈশ্বরদী উপজেলায় ৩ লাখ ৪১ হাজার ২শ লিচু গাছ রয়েছে। শুধু এই উপজেলায় মোজাফফর (দেশি) বোম্বাই, চায়না-৩, বেদানা জাতের লিচু আবাদ করেছে কৃষকরা। এবার ১০ শতাংশ লিচু গাছে ফুল-ফল আসেনি। প্রতি ১ হেক্টর জমিতে ১১২টি লিচু গাছের ইউনিট থাকে। এছাড়াও বসতভিটা বাড়ির আঙিনা-উঠানে তো লিচুর গাছ রয়েছেই।  

তিনি আরও জানান, ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষিবিভাগ প্রতিটি লিচু 'দুই' টাকা মূল্যে দাম নির্ধারণ করে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৩৪৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যদি আড়াই টাকায় প্রতি লিচু বিক্রি হয় তাহলে ৪২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। যদি আবহাওয়াটা অনুকূলে থাকে, বৈরী কোনো আবহাওয়া সৃষ্টি না হয়, ঝড়-বৃষ্টি, অতিরিক্ত গরম না পড়ে তাহলে সারা বছরের কষ্টের আবাদ লিচুতে ৬০০ কোটির বেশি টাকা ঘরে তুলতে পারবে কৃষক। কোনো কারণে লিচুর দাম বাড়লে আরও বেশি টাকা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সোমবার (২৩ মে) সরেজমিনে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লিচুগ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামগুলো অপরূপ সৌন্দর্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দম ফেলার সময় নেই বাগানের লিচুর চাষিদের। সকালে থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত রোদ্র ছায়ায় বসে বেশ উৎসবের মত লিচু পাড়ার ধুম পড়েছে। নাটোর-পাবনা-কুষ্টিয়া বিশ্বরোডের কৈলেরকান্দি বটতলা, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারী, নতুনহাট। কুষ্টিয়া-পাবনা আঞ্চলিক সড়কের নতুন রূপপুর, ছিলিমপুর, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাদা, সাঁহাপুর-দাশুড়িয়া গ্রামীন সড়কে জগন্নাথপুর, বক্তারপুর, ভাড়ইমারী, যতদূর চোখ যায় দেখা মিলবে সবুজ পাতার মাঝে থোকা-থোকা লাল রঙের লিচু। গাছের ডালে পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে।  

যেকোনো লিচু বাগানে ঢুকলে দেখা যায়, বাগান মালিক, লিচু চাষি, ব্যবসায়ীদের দিনভর ব্যস্ততা। গাছে চড়ে কেউ লিচু ভাঙছেন, কেউবা লিচু থরে থরে সাজানোর কাজ করতে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। আবার কেউবা বাছাই করে আটি বেঁধে রাখছেন। কেউ লিচুর ঝুড়িতে মোকামে পাঠানোর জন্যই ঝুড়ি সেলাই করছেন।  

মধু মাস জৈষ্ঠ্যের আগে থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মোজাফফর (দেশি) জাতের লিচু প্রায় শেষ হয়। এ বছরে আটিঁর লিচু প্রতি হাজারে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছে বাগান মালিকরা। এদিকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে বাগান ঘুরে, বিভিন্ন হাট-বাজারে ঘুরে লিচু ক্রয় করছেন। কেউবা লিচু গাছে মুকুল আসার পর বাগান কিনে রেখেছিলেন। দুই মাস পরিচর্যা করে এখন গাছ থেকে লিচু পেড়ে দেশের বিভিন্ন মোকামে নিয়ে যাচ্ছেন।

উপজেলার হাট-বাজার ও শহরের অলিগলিতে বিক্রি হচ্ছে লিচু। ক্রেতারা বছরের প্রথম ফলের স্বাদ নিতে বেশ সানন্দে ক্রয় করছেন। সাধ্যের মধ্যে ধনী-গরিব সবাই লিচু ক্রয় করছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিদ মিতা সরকার বাংলানিউজকে বলেন, আবহাওয়া সম্পূর্ণ অনুকূলে থাকায় ঈশ্বরদী উপজেলার ৩ হাজার ১শ হেক্টর জমিতে তিন প্রজাতির লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। লিচুর স্বাদ মান গুনগত, লিচুর আঁটি ছোট হওয়ার কারণে বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা রয়েছে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। অন্য ফসলের চেয়ে লিচু চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে, এতে বাগানের সংখ্যাটাও বাড়ছে।  

তিনি আরও বলেন, ঈশ্বরদী ১১ হাজার ২৫৮ বাগানে ৩ লাখ ৪১ হাজার ২শ লিচু গাছ রয়েছে। আর সলিমপুর, সাঁহাপুর, পাকশী ইউনিয়নে বাড়ির আঙিনা ও উঠান জুড়ে লিচু গাছ নেই-এমন বাড়ি কম। ঈশ্বরদীতে প্রায় ৮ হাজার কৃষক লিচু আবাদে রয়েছেন।  

কৃষিবিভাগ একপিস লিচু 'দুই' টাকা মূল্যে দাম নির্ধারণ করে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৩৪৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এখন যদি ঝড় বৃষ্টি আর না হয় আবহাওয়াটা অনুকূলে থাকে, অতিরিক্ত গরম না পড়ে তাহলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে লিচুর বাগান মালিকরা তাদের সারা বছরের কষ্টের উপার্জিত অর্থ, লিচুতে ৬শ কোটি টাকা ঘরে তুলতে সক্ষম হবে বলে আমরা আশাবাদী।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২২ 
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।