ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

অর্থ সংকট ও দাম না পাওয়ায় চামড়া ব্যবসায় কমেছে ফড়িয়া

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২২
অর্থ সংকট ও দাম না পাওয়ায় চামড়া ব্যবসায় কমেছে ফড়িয়া

ঢাকা: কোরবানির চামড়া ক্রয়–বিক্রয়ের দেশের সবচেয়ে বড় মোকাম পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তা। সোমবার (১১ জুলাই) ঈদের দ্বিতীয় দিনেও বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া আসছে পোস্তায়।

আগামী দুই মাস এই বেচাবিক্র চলবে। তবে অর্থ সংকট ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় আগের মতো এখন আর ফড়িয়ারা পোস্তায় চামড়া নিয়ে আসেন না। ফলে এ বছর চামড়া আমদানি কম হয়েছে।

এদিকে একদিকে অর্থসংকট, অন্যদিকে চামাড়ার দাম না থাকায় পোস্তায় ফড়িয়াদের আনাগোনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমে গেছে। এ অবস্থায় মাদরাসার ছাত্ররা কোরবানির পর বিভিন্ন এলাকা থেকে দানের চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন পোস্তায়। তাই চামড়ার বাজারে ফড়িয়াদের দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আড়ৎদার ও এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

ঈদের দুই দিন পোস্তায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন যতই যাচ্ছে, পোস্তায় ফড়িয়ার সংখ্যা ততই কমছে। গত কয়েক বছর ধারাবাহিক লোকসান, চামড়ার সঠিক দাম না পাওয়া, রাস্তায় চাঁদাবাজি, ট্যানারি মালিকদের সরাসারি চামড়া ক্রয় করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ পানির দামে বিক্রির করার চেয়ে কোরবানির পশুর চামড়া মাদরাসায় দিয়ে দেয়। এসব কারণেও  ফড়িয়া বা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে ছমির হানিফ অ্যান্ড সন্সের মালিক হাজী মো. ছমির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ৪৬ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। এখন পোস্তায় আগের মতো ফড়িয়ারা চামড়া নিয়ে আসে না। অনেকেই সরাসরি ট্যানারিতে চলে যায়। কারণ কোরবানির পর বিভিন্ন স্থানের চামড়া সংগ্রহ করে ফড়িয়ারা। এখন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় মাদরাসার ছেলেরাও। সাধারণ মানুষ চামড়ার উপযুক্ত দাম না পওয়ায় এবং সওয়াবের আশায় মাদরাসায় চামড়া দান করেন। ফলে ফড়িয়ারা চামড়া কিনতে পারে না। সেই সঙ্গে তারা গত কয়েক বছর চামড়া কিনে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে অর্থ সংকটে এখন আর কেউ চামড়া কেনে না। যারা কেনেন, তারা সরাসরি চলে যাচ্ছেন ট্যানারিতে। আগে এখানে ২ থেকে ৩ হাজার ফড়িয়া আসতো। এখন সেখানে ৬০০ থেকে ৮০০ ফড়িয়া চামড়া নিয়ে আসে।

আমীর হোসেন অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক হাজী মো. আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ফড়িয়ারা চামড়া নিয়ে কম আসে। তারা আসলে বোঝে না। যখন থেকে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া শুরু করলো, সেই থেকে ফড়িয়ারা চামড়া কিনে লোকসান দিতে থাকে। ধারাবাহিক লোকসান দিয়ে অনেক ফড়িয়া নিঃস্ব হয়ে গেছে। তারা না বুঝেই বেশি দাম দিয়ে চামড়া কিনে কম দামে বিক্রি করে লোকসান করে। তাদের এই জায়গাটা পূরণ করেছে মাদরাসাগুলো। তারা দানের চামড়া নিয়ে এসে বিক্রি করে। তাদের এতে লাভ-লোকসানের হিসেব নেই। তবে এখন মাদরাসাগুলোও বিভিন্ন স্থান থেকে দানের চামড়ার সঙ্গে কিনেও চামড়া নিয়ে আসছে। ফলে ফড়িয়াদের চামড়া কেনার সুযোগ কমে যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধেরগঞ্জের এক মাদরাসা থেকে প্রায় ১০০ চামড়া নিয়ে এসেছেন শিক্ষক মো. আবদুল বাতেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এলাকার বিভিন্ন বাড়ি থেকে ছাত্ররা চামড়া সংগ্রহ করেছে। বেশিরভাগ চামড়িই দানের। ৩০টির মতো চামড়া আমরা কিনে এনেছি। এই চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে মাদরাসার উন্নয়নমূলক কাজ এবং এতিম বাচ্চাদের ভরণপোষণে খরচ করা হবে।

দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবছর দাম ১০০ টাকা বেশি পেয়েছি। তবে গরুর চামড়া নিলেও খাশির চামড়া নিচ্ছে আড়ৎ মালিকরা। আমাকে গড়ে ৬৫০ টাকা দাম দেবে বলেছে। কিন্তু চামড়া নামানোর পর বলে ২০টা বাতিল। সেগুলোর দাম ৩০০ টাকা দেবে। যা স্পষ্টতই অন্যায়। এরকম করলে তো চামড়া এখানে নিয়ে আসা যাবে না।

সোনারগাঁও থেকে ফড়িয়া বা মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. আব্দুল রশিদ ৩৮০ পিস চামড়া নিয়ে পোস্তায় এসেছেন। তার কাছে দাম জানতে চাইলে বলেন, একেবারে ছোট চামড়ার দাম ৪৫০, মাঝারি চামড়ার দাম ৬৫০ এবং বড় চামড়ার দাম ৮৫০ টাকা দিয়েছে। তার মধ্যে শতকরা ২০ শতাংশ বাতিল যাবে। বাতিল চামড়াগুলো ৩০০ টাকা পিস দেবে। এবছর দাম কিছুটা ভালো, কিন্তু আমরা এখন আর চামড়া কিনতে পারি না মাদরাসার জন্য। মাদরাসার ছেলেরা দুই দিন আগেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া চেয়ে আসে। মানুষও তাদের চামড়া দান করে দেয়। সে পর্যন্ত থাকলে কোন সমস্যা হতো না। এখন মাদরাসার ছেলেরা দাম দিয়ে চামড়া কিনে আনে।   ফলে আমরা আর চামড়া পাই না। দাম বেশি দিতে চাইলেও বলে আমরা মাদরাসায় দিয়ে দিছি। এভাবে চললে এই ব্যবসা ছেড়ে চলে যেতে হবে।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বাংলানিউজকে বলেন, চামড়া খাত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। এখানে ৩৫০ জন তালিকাভুক্ত আড়ৎদার এবং ১৬০০ থেকে ২০০০ ফড়িয়া আছে। তাদের চাহিদাগুলো আমাদেরই বাস্তবায়ন করতে হয়। আমাদের এখানে আগে হাজার হাজার ফড়িয়া ছিল। গত কয়েক বছর চামড়ার দর পতনে আর্থিক সংকটে পড়ে তারা নিঃস্ব হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। এখন অনেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে নেই। ফলে এখন মাদরাসার লোকজনের বেশি সমাগম লক্ষ্য করা যায়। যতদিন মানুষ মাদরাসার কাছে চামড়া দেবে, ততদিন তারা টিকে থাকবে। এখন ফড়িয়ারা হারিয়ে গিয়েছে অর্থ সঙ্কটের জন্য।

তিনি বলেন, এবছর চামড়ার দাম বেশি পাচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি আমাদের সংরক্ষণ খরচ বেড়েছে। তারপরও আমাদের লোকসান হবে না। কারণ যখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দেয়, তখন আমরা ব্যবসায়ীরা সমন্বয় করে ফুট প্রতি ৫ টাকা বেশি ধরেছি। এর সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী আরও ২ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে লোকসানের কোনো সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আপনার কাছে টাকা না থাকা। টাকা থাকলে সবকিছু করা যায়। টাকার কোনো বিকল্প নেই। যখনই আমরা অর্থ সংকটে পড়ি বা আমাদের অর্থ অন্যের হাতে চলে যায়, তখন আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়ি। এছাড়া এবছর প্রচণ্ড গরম, এটাও একটা সমস্যা। এজন্য আমরা বারবার বলছি কোরবানির ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ দিতে হবে। তাহলে রাষ্ট্রের এই মূল্যবান সম্পদ রক্ষা পাবে।

রাত হলে কেন চামড়ার দাম কমে যায়- জানতে চাইলে টিপু সুলতান বলেন, দেখুন যে পশুটা কোরবানি দেওয়া হয়েছে সকাল ৮ টায়, সেই চামড়া রাত ৮টায় নিয়েলে গুণগত মান ঠিক থাকে না। চামড়ায় পচন ধরে। তখন ফড়িয়া বলে দাম যেটাই হোক চামড়াটা রাখেন। আর আড়ৎদারতো জেনেশুনে লোকসান দেবে না। তখন তারাও একটা মিনিমাম দাম দিয়ে চামড়াটা রেখে দেয়। আর তখন মিডিয়াতে আসে চামড়া পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরেকটা সমস্যা রয়েছে, তা হলো রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম থাকে। সেজন্য সময় মতো চামড়াগুলো আড়তে নিয়ে আসতে পারে না। এ কারণে ফড়িয়ারা যে কোনো দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর রাত হলে চামড়ায় পচন ধরে। তখন ৮০০ টাকার চামড়া ৩০০ টাকায় দিতেও তারা বাধ্য হয়। একই সঙ্গে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত জনবল ও লবণ থাকে না। ফলে সংরক্ষণ করা কষ্ট হয়ে যায়।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা নির্ধারণ করে। ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে ও ঢাকায় বকরি ও খাসির চামড়ার দাম একই থাকবে।

গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা ও বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তার মানে চলতি বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭ টাকা এবং খাসির চামড়ায় ৩ টাকা বেশি দাম নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়।

পোস্তার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুট হয়। একেকটি গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরিসহ গড়ে ৩০০ টাকা খরচ হয়। গত বছরের তুলনায় এবার লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় খরচ কিছুটা বেশি পড়ছে।

ধরা যাক, একটি মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার আয়তন ২৫ বর্গফুট। তাহলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দর অনুযায়ী, লবণযুক্ত সেই চামড়ার দাম হয় ১ হাজার ২৩৭ টাকা। তার থেকে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে লবণবিহীন কাঁচা চামড়ার দাম হওয়ার কথা ৯৩৭ টাকা। তবে সোমবার পোস্তায় ছোট আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। মাঝারি আকারের বেশির ভাগ বিক্রি হয়েছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। বড় চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু প্রস্তুত ছিল। গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।

>>> আরও পড়ুন: লবণ ছাড়া চামড়া আসছে ট্যানারিতে, দাম কম দেওয়ার অভিযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১,২০২২
জিসিজি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।