শাবিপ্রবি (সিলেট): প্রতিবছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) বিভিন্ন আন্তঃবিভাগ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব খেলাকে কেন্দ্র করে এক বিভাগের শিক্ষার্থীর সঙ্গে আরেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো না কোন দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা, মারামারি কিংবা হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে।
এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে অশ্রাব্য ভাষায় ‘স্লেজিং’, কটুক্তি, মানহানিকর কথা, অশালিন আচরণ, বুলিং, ইশারা-ইঙ্গিত, হেনস্থা, ব্যক্তি আক্রমণসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে।
এদিকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃবিভাগ ভলিবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতার চতুর্থ দিনে পরিসংখ্যান বিভাগ ও পলিটিক্যাল স্টাডিজ (পিএসএস) বিভাগের মধ্যে খেলা হয়। এ ম্যাচে পরিসংখ্যান বিভাগ ০-২ সেটে পিএসএস বিভাগের কাছে হেরে যায়। তবে ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই বিভাগের শিক্ষার্থীর মধ্যে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগ ও পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের মধ্যে ম্যাচ চলাকালীন সময় দুই বিভাগের শিক্ষার্থীরা একে অপরকে একটানা স্লেজিং করছিল। এতে শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা গেছে পিএসএস লুথা, স্ট্যাট, লুথা, টিনের চালে কাউয়া, হৈ হৈ রই রই পিএসএস গেলি কই? হৈ হৈ রই রই স্ট্যাট গেলি কই? এক-দুই-তিন-চার ওমুখ বিভাগ মাঠ ছাড়’সহ বিভিন্ন অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে স্লেজিং করতে দেখা গেছে।
পরবর্তীতে পিএসএস বিভাগ জয় পাওয়ার পর মাঠের স্লেজিংকে কেন্দ্র করে দুই বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এতে কয়েকজনকে মারধরের জন্য তেড়ে যেতে দেখা যায়। স্লেজিং চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, তবে স্লেজিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। স্লেজিং কেন্দ্রিক এমন ঘটনা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃবিভাগ খেলাগুলোতে ছেলে-মেয়ে উভয় প্রতিযোগিতায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এমন স্লেজিং যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিভাগগুলোর মধ্যে অন্তর্কোন্দল, মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসএস বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা কাম্য ছিল না। খেলার সময় পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাদের খেলোয়াড়দের নাম ধরে অশ্রাব্য ভাষায় স্লেজিং করছিল। আমরা স্লেজিং করেছি, তবে তা মার্জিত ভাষায়। এ সময় সে বিভাগের দুই-একজন শিক্ষক আমাদের দিকে তেড়ে আসে। তারা আবার প্রশাসনিক দায়িত্বেও রয়েছেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলেন, খেলা শেষে আমরা হেরে যাওয়ায় মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। তখন পিএসএস বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাদের দিকে এসে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। পরে আমাদের সঙ্গে তাদের ঝামেলা লেগে যায়।
ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী প্রক্টর আব্দুল্লাহ আল ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খেলা শেষে তারা হারার পর দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে গেছিল। তবে ওখানে তেমন কিছুই হয়নি। আমরা সেখানে ৪ জন সহকারী প্রক্টর ছিলাম। বিভাগগুলোকে আমরা অবহিত করেছি, পরবর্তী সময় থেকে তারা যাতে এমন আচরণ না করে।
এ বিষয়ে খেলাধুলা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, খেলাধুলায় স্লেজিং কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব বিষয়ে আমরা সবসময় সতর্ক করে আসছি। বিভাগগুলোকে আবারো লিখিত চিঠির মাধ্যমে বিষয়গুলো অবহিত করা হবে। এভাবে চললে আমরা খেলাধুলা বন্ধ করে দিব, এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরে তিনি যুবসমাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও গবেষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় স্লেজিং বিষয়ে এ অধ্যাপক বলেন, নৈতিক মূল্যবোধের অনুশীলন না করার ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়টা বেশি ঘটছে। ফলে আমরা যা খুশি তাই বলতে দ্বিধাবোধ করছি না! শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়টিই ইদানিং বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্লেজিং থাকলে খেলাধুলায় আর ‘ফেয়ার প্লে’ বিষয়টি দেখা যায় না।
শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। এজন্য মাসিক কিংবা সাপ্তাহিক বিভিন্ন কর্মশালা, সিম্পোজিয়াম, ওরিয়েন্টেশন ও ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা খেলাধুলা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব আচরণ রোধে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করতে পারেন, তখন এসব ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।
প্রসঙ্গত, প্রতিবছর শাবিপ্রবিতে আন্তঃবিভাগ ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবলসহ বিভিন্ন আন্তঃবিভাগ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়। এসব খেলায় স্লেজিংকে কেন্দ্র করে একাধিকবার হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহতও হয়েছেন। প্রশাসন থেকে এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও দিন দিন স্লেজিং যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, কমছেই না! আগে স্লেজিংগুলো একটু সহনীয় মাত্রায় থাকলেও ইদানিংকালের তা হয়ে উঠেছে আশ্রাব্য ভাষার অন্যতম হাতিয়ার। অনেক সময় ব্যক্তিগত ক্ষোভকেও স্লেজিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। আর এমন অরুচিশীল সংস্কৃতি চর্চা করানো হয় নবীন, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩
জেএইচ