ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

অদম্য ওরা, বাধা ডিঙিয়ে এগোচ্ছে সম্মুখে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
অদম্য ওরা, বাধা ডিঙিয়ে এগোচ্ছে সম্মুখে

ঢাকা: বয়স তিন বছর পেরিয়ে গেলেও নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিতো না জায়েদ ইমাম আপন। কোনো কাজ নিজে করতে পারত না, এক মিনিটও স্থির হয়ে বসতো না, ভীষণ চিৎকার করতো।

ছেলের স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না বুঝতে পেরে ঢাকায় শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন জাফর-সারমিন দম্পতি।  

চিকিৎসক জানান, অটিজমের কারণে আপনের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করলে ওর সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে।

আপনের মা সারমিন সুলতানা বলেন, ‘আপনের অটিজমের বিষয়ে জানার পর আমার আরেকটি কন্যাসন্তান হয়। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে জানতে পারি আমার মেয়ে জেবা ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। আপনের বাবার গোপালগঞ্জে ছোট একটা ফার্মেসি আছে। একজনের আয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না, সেখানে ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তি করার খরচ দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের ব্যাপারে জানতে পেরে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। স্কুলে এসে জানতে পারি অটিজমে আক্রান্তসহ দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে। স্কুলের পাশে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে দুই সন্তানকে এ স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। ছয় মাসে আমার ছেলেমেয়েদের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আপন এখন বসতে পারে, নিজে টয়লেট করতে পারে, ডাকলে সাড়া দেয়, কথা শুনে উত্তর দিতে পারে। আমার তিন বছরের মেয়ে মা বলে ডাকতে শিখেছে। বাবা বলে যখন ডাকে ওর বাবা চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। এত বছর পরে এসে আমরা সন্তানের মুখে বাবা-মা ডাক শুনতে পাচ্ছি। ’

ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে সুবিশাল দুটি বহুতল ভবন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশন। ২০১৭ সালের ১ মার্চ প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র পরিবারের ৪০৪  প্রতিবন্ধী শিশু বিনামূল্যে পড়াশোনা করছে। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিকভাবে নিজের কাজ নিজে করা, গান-নাচ, অঙ্কন, সেলাই মেশিনের কাজ থেকে শুরু করে ব্লকবাটিক, তসবি, হরেক ডিজাইনের গলার মালা, কানের দুল পর্যন্ত তৈরি করতে শিখছে এ শিশুরা। ধর্মীয় শিক্ষা, নামাজ পড়া, কেনাকাটা করতে শেখা, আর্থিক লেনদেনের হিসাব রাখা শেখানো হচ্ছে শিশুদের। চিকিৎসকের সাহায্যে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, অকুপেশন থেরাপি দেওয়া হয় এবং হাতেকলমে তা মায়েদের শেখানো হয়। যাতে বাড়িতেও তাঁরা সন্তানদের যত্ন নিতে পারেন। সমাজে স্বাভাবিক চলাফেরা, নিজের প্রতিদিনের কাজ নিজে করতে পারা এবং স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে আয় করার জন্য কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে শিশুদের। অনাবাসিক এ প্রতিষ্ঠানে স্কুলবাসে শিশু ও মায়েদের নিয়ে আসা এবং যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন কর্তৃপক্ষ।

বসুন্ধরা স্পেশাল চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের প্রধান শিক্ষক শায়লা শারমিন বলেন, ‘এখানে বিশেষ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ শিক্ষায় পারদর্শী শিক্ষক, মনোবিজ্ঞানী ও থেরাপি বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ শিক্ষা কারিকুলাম। এখানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের বিকাশ, দৈনন্দিন কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, অঙ্গ সঞ্চালনগত দক্ষতা বৃদ্ধি, ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমও চলছে সমান গতিতে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘এ কারিকুলাম বাস্তবায়নে আট বিভাগে ভাগ করে মোট ১৮টি সুপরিসর শ্রেণিকক্ষে দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রেণিসহকারীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এ শিক্ষা কার্যক্রম। এখানকার বেশির ভাগ শিক্ষক বিশেষ শিক্ষায় ডিগ্রি, বিএসএড সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে রয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে তার সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রতি ছয় মাস পর পর শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিষয় মূল্যায়ন করে অগ্রগতি নির্ধারণ এবং উৎসাহিত করতে পুরস্কৃত করা হয়। ’

সরেজমিন স্কুল ঘুরে দেখা যায়, স্কুলজুড়ে রংধনুর সাত রঙের ছড়াছড়ি। প্রজাপতির মতো হেসেখেলে বেড়াচ্ছে শিশুরা। প্রতিটি সেকশনে আলাদা পদ্ধতিতে শেখানোর কার্যক্রম চলছে। বয়স, শারীরিক, মানসিক অবস্থার অগ্রগতির ওপর ভাগ করে বিভিন্ন সেকশন করা হয়েছে। এএসডি-২ সেকশনে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষক নূরুল আমিন শিশুদের খাদ্যশস্য চেনাচ্ছিলেন। ধান, গম, ডাল, ভুট্টা, সরিষা, ধনে প্রতিটি শস্য আলাদা কৌটায় রাখা। এ ছাড়া চিনি, লবণ, হলুদ, মধু, ময়দাও রাখা হয়েছে চেনানোর জন্য। ক্লাসে ঢুকলেই সবাই সালাম দিয়ে একযোগে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাসিমুখে করে কুশলবিনিময়। এ সময় একগাল মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে পরিচয় হতে চায় ছয় বছরের শিশু রূপা। শিক্ষকরা জানান, রূপার পরিবার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জেই থাকে। তার বাবা  নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেন। আগে এলোমেলো চুলে ধুলো মেখে ঘুরে বেড়াত মেয়েটি। রূপাকে আগে এলাকায় পাগলি বলে ডাকত লোকজন। মাস ছয়েক আগে স্কুলে ভর্তি করা হয় রূপাকে। এখন স্কুলের ইউনিফর্মে পরিচ্ছন্ন রূপা। লাল ফিতা দিয়ে বেণি করে চুল বাঁধা। শিক্ষকের সহযোগিতায় খাতায় নিজের নাম লিখতে শিখছে। তার রিপোর্ট কার্ডও আশাব্যঞ্জক।

সিঁড়ি দিয়ে এক তলা ওপরে উঠতেই দেখা যায় শিশুদের কলরব। রুমজুড়ে শিশুদের বিভিন্ন রকম খেলার সামগ্রী। লাল, নীল, হলুদ রঙিন তুলতুলে নরম বলের প্লে জোনে খেলাধুলায় মেতে উঠেছে শিশুরা। কেউ যেন পড়ে না যায় কিংবা ব্যথা না পায় এজন্য সতর্ক স্কুলের কর্মীরা। অনেককে খেলাধুলার মাধ্যমে হাত-পায়ের কসরত করানো হচ্ছে। সবার সঙ্গে মিশতে শিখছে, হাসছে-খেলছে, কথা বলতে শিখছে শিশুরা। সাইক্লিং করছিল ফারহান।

ফারহানের মা সায়মা বলেন, ‘দুই বছর বয়স পার হলেও সাড়া দিত না, তাকাত না, ডাকতে শিখছিল না ফারহান। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ফারহান অটিজম সমস্যায় ভুগছে। অনেক দেরিতে হাঁটা শিখেছে ফারহান। শ্রীমঙ্গলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল ফারহানের বাবা। এ স্কুল সম্পর্কে শুনে আরও ভালোভাবে জানার জন্য এসে দেখে আমাদের খুবই ভালো লাগে। মনে হয় এখানে ভর্তি করালে আমার ছেলের অবস্থার উন্নতি হবে। এ স্কুলে ভর্তি করার জন্য ফারহানের বাবা চাকরি ছেড়ে দেয়। ছেলেকে নিয়ে আমরা কেরানীগঞ্জে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। আট মাসে ফারহানের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। আমার ছেলে সবার সঙ্গে মেশে, কথা বলে, খেলাধুলা করে, পড়াশোনা শেখার চেষ্টা করে। ’ ছেলের কথা বলতে বলতে আনন্দে মায়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। মাকে দেখে খেলতে খেলতে দৌড়ে এসে আঁচল ধরে একটু ঘুরে যায় ফারহান। এক ক্লাসে দেখা যায় নামাজ পড়তে শিখছে ছেলেরা। পাশের আরেকটি ক্লাসে তসবি, মালা, কানের দুল বানাচ্ছে মেয়েরা। সেলাই মেশিন ঘুরিয়ে কামিজ বানাচ্ছে আরেক শিক্ষার্থী। দায়িত্বরত শিক্ষক জানান, মেয়েদের ব্লকবাটিকের কাজ, হাতের সেলাই, গার্হস্থ্য শিক্ষা, রান্না করা, নারীস্বাস্থ্য, সন্তান পালন শেখানো হয়। শুধু পড়াশোনা আর কারিগরি কাজই নয়, শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের বিপদে পাশে দাঁড়ায় এ প্রতিষ্ঠান। রয়েছে মানবিকতার অসংখ্য ঘটনা।

আরেক ক্লাসে দেখা যায় পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ‘ধিতাং ধিতাং বলে কে মাদলে তান তোলে, কার আনন্দ উচ্ছলে আকাশ ভরে জোছনায়’ গানে নাচ শিখছে একদল ছেলেমেয়ে। পাশের ক্লাসে হারমোনিয়ামের রিড চেপে শিশুরা সুর তুলছে ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই-লুকোচুরি খেলা। ’ শিশুদের উল্লাস দেখে মনে হয় এ যেন এক আনন্দের স্কুল।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।