ঢাকা: বইটি রঙিন ছবি সংবলিত নয়। তারপরও শিশুদের আকর্ষণ থাকতো অমোঘ।
শ্রী শ্রী সীতানাথ বসাকের এই আদর্শ লিপি চোখে পড়লো সম্প্রতি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে। সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আকাঁবাঁকা মেঠো পথ চলে গেছে গ্রামের ভেতর। সেই গ্রামের শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার পথেই ষাটোর্ধ্ব কাদের দাদার দোকান। পুরনো কিছু খাতা অবিক্রিত হয়ে পড়ে আছে, ধুলো জমেছে। সেখানেই দেখা মেলে আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয় বই দু’টির। নব্বই দশক পর্যন্ত যাদের অ, আ, ক, খ এর হাতে খড়ি হয়েছে গ্রামে, তাদের বেশিরভাগেরই আদর্শ লিপির সঙ্গে পরিচয় রয়েছে। আদর্শ লিপিতে থাকা বর্ণগুলো ‘চক’ দিয়ে ফুটে উঠতো সিলেটে। বর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভেঙ্গে পড়তো অনেক সময়ই ‘চক’। হাতের চকের গুড়া মুখেও লেগে যেতো শিশুদের। আর শ্লেটে ফুটে ওঠা আদর্শ লিপির বর্ণ লেখা আর মুছতে মুছতে কালো শ্লেট সাদাই হয়ে যেতো কোন এক সময়।
সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা নাজমুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, এখনতো আর আদর্শ লিপি নেই। সরকার থেকেই প্রাক প্রাথমিকের রঙিণ বই দেয়া হয়। সেখানেই অক্ষর জ্ঞানের শিক্ষা থাকে। তবে এতো আচার ব্যবহারের আদর্শ কথা না থাকলেও রঙিন ছবিতে বড়কে সন্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, মিথ্যা কথা না বলার মতো জ্ঞানবাক্য গুলো শেখানো হয়।
দোকানদার কাদের জানান, বেশ কয়েক বছর আগে লেখার খাতার সঙ্গে এই বইটি সৌজন্য হিসেবে তাকে দেয় কোম্পানি। মাঝে মাঝে নিজেও বইটি উল্টিয়ে দেখেন। বলেন, এখন তো শিশুরা বই পড়ে, কিন্তু নীতি বাক্য শেখে না। আমরাও শিশু বয়সে মক্তবে এই নীতিবাক্য শিখেছি। ছোট বেলার এই শিক্ষা মানুষের আজীবন মনে থাকে। এরপরে যে ধইরা রাখে, সে রাখে, নাইলে বিপথে যায়।
১২ কবিরাজ লেনের নাদিম প্রোডাক্টস আদর্শ লিপি’টি প্রকাশ করেছে। আবু বক্কর আর্টস প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছে বইটি। নিউজ প্রিন্টের ধরন অনুযায়ী বইটির মূল্য ২ ধরনের। ‘নিউজ’ (একটু গৌর বর্ণের নিউজপ্রিণ্ট) এর মূল্য ৫ টাকা এবং ‘সাদা’র (একটু পরিষ্কার বর্ণের নিউজ প্রিণ্ট) মূল্য ৭ টাকা। তবে নাদিম প্রডাক্টসেরই এই বইয়ের মূল্য সামনের কাভারে লেখা রয়েছে ১০ টাকা।
বইয়ের প্রথম পাঠ স্বরবর্ণ। আমাদের স্বরবর্ণের সংখ্যা ১১ টি বলেই জানা। কিন্তু আদর্শ লিপির স্বরবর্ণ ১৫ টি। তবে ‘৯’ কে সংখ্যা হিসেবে এখন সবাই জানে। আদর্শ লিপিতে কিন্তু ‘৯’ একটি স্বরবর্ণ। যার উচ্চারণ হতো ‘লী’ এর মতোন। এছাড়াও ‘৯’ এর মাথায় আরেকটি ‘৯’ দিয়েও হতো আরেকটি বর্ণ। ‘অং’ এবং ‘অঃ’ বিবেচিত হতো স্বরবর্ণ হিসেবে। আর জ্যেতি চিহ্নসহ ব্যঞ্জন বর্ণের সংখ্যা ৪১ টি।
তৃতীয় পাঠে বানান ও স্বরবর্ণের যোজনা। ৩ থেকে ৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যঞ্জণবর্ণগুলোর সঙ্গে স্বরবর্ণের যোজনা এবং ‘য’ ফলা, ‘র’ ফলা, ‘ল’ ফলা, ‘ব’ ফলা, ‘ন’ ফলা, ‘রেফ’ ফলা, ‘ম’ ফলার যোজনার পাঠ।
এসব শেখা হলেই ৮ নং পৃষ্ঠা থেকে বাক্য গঠন। এই বাক্য গঠনগুলো হতো নীতি বাক্য গঠন। যেগুলো শিক্ষার্থীদের মুখস্থও করানো হতো। ছবি যুক্ত ‘অজগর’ সাপ, ‘আম’ এসে বাক্য গঠনের শিক্ষা পাল্টে যায়। আদর্শ লিপি’তে ‘অ’ এর বাক্য গঠন, ‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর’। পরবর্তীতে নতুন ছবিওয়ালা বই এসে শেখানো হয়, ‘অ’ তে ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’। আদর্শ লিপিতে শেখানো হয়, ‘আ’তে আলস্য দোষের আকর। পরবর্তীতে এটা পাল্টে ছবির বইতে হয়ে যায়, ‘আমটি আমি খাবো পেড়ে।
বাক্য গঠন শেখা হয়ে গেলে, সময় নিয়ে শ্রুতি বাক্যের পাঠ। ‘খেলায় মজিয়া শিশু কাটাইও না বেলা, সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা। ’
এরপরই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের চিরসবুজ কবিতা, ‘কে বড়?’ ‘আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়...’। এরপরই রয়েছে, পিতা মাতা’র ভক্তির জন্যে পাঠদান। যেখানে বলা হয়েছে, ‘পিতামাতা আমাদের পরম গুরু, তাঁহারা কত যত্নে ও কত কষ্টে আমাদিগকে লালন পালন করিয়াছেন। আমাদের সুখের...। ’ এই বাক্য গঠন এবং শ্রুতি বাক্য পাঠে সাধু ভাষার প্রচলন রয়েছে। তবে এখন সাধু ভাষা এক কথায় উঠেই গেছে বলা যায়।
আদর্শ লিপি’র সুবাদে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুর প্রার্থনা’ কবিতাটি হয়ে উঠতো শিশুদের শেখা প্রথম কবিতার চরণ। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...। ’ ১০তম পৃষ্ঠায় আরো রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের শ্রুতি শ্লোক, স্রষ্টার বন্দনা। ‘করিলেন যিনি এই জগৎ সৃজন...। ’
শুধু বাংলা বর্ণমালা এবং বাক্য গঠনের পাঠ দিয়েই শেষ হয় না আদর্শ লিপি। রয়েছে ‘শতকিয়া’। যেখানে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো মুখস্থ করানো হতো। একই সঙ্গে রয়েছে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারের পাঠ। যাকে বাংলায় বলা হয়েছে, ‘ছাপার বড় অক্ষর’। ২৬ টি ইংরেজি বর্ণমালার নিচেই বাংলায় তার উচ্চারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ‘A’ এর উচ্চারণ ‘এ’ শেখা হতো। যা এখন ‘আ’ তে রুপান্তরিত হয়েছে।
আদর্শ লিপি’র শেষ পৃষ্ঠায় ইংরেজি স্মল লেটার, বা ছোট হাতের অক্ষর। এরপর বাংলা সাতবার, ইংরেজি সাতবার এবং বাংলা বার মাসের নাম পাঠের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আদর্শ লিপি।
এই সমাজ থেকে এখন আদর্শ লিপি উঠে গেছে। হয়তো এর সঙ্গে কিছু আদর্শেরও বিলীন হয়েছে। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের পাশেই ফয়জাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরিক্ষার্থী সুন্দ্রাটিকি গ্রামের রুবেল খুনের আসামি হিসেবে কাঠগড়ায়। একই গ্রামের ৭ থেকে ১০ বছরের ৪ শিশু হত্যায় জড়িতের অভিযোগে কারাগারে সে। একই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী তার বড় ভাই জুয়েলও একই মামলায় কারাগারে।
স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক আকবর হোসেন বলেন, এই শিক্ষার্থীদের আমরা ক্লাস পাশ করাইছি। মানুষ করতে পারি নাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৬
জেডএম