লক্ষ্মীপুর: জীবনাচরণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত অনুসরণীয় নির্দেশনা- ফেস্টুন তৈরি করেছেন লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী।
ফেস্টুনটি জেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সুন্দর আগামীর লক্ষ্যে ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে জেলা প্রশাসকের এই উদ্যোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সচেতন মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য জেলা প্রশাসকে দেওয়া অনুসরণীয় নির্দেশনা বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনুসরণীয় নির্দেশনা
১. জীবনাচরণ সংক্রান্ত:
১.১ পিতা-মাতা, শিক্ষক ও গুরুজনের আদেশ-নিষেধ এবং উপদেশ মেনে চলতে হবে।
১.২ ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে।
১.৩ বড়দের শ্রদ্ধা করতে হবে ও সালাম দিতে হবে এবং ছোটদের স্নেহ করতে হবে।
১.৪ নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
১.৫ প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে।
১.৬ সব ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখতে হবে, অশ্লীলতা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
১.৭ শুদ্ধ ও সঠিক উচ্চারণে কথা বলতে হবে এবং সবার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
১.৮ অধিক রাত না জেগে সময়মতো ঘুমাতে হবে এবং ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
১.৯ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। রাষ্ট্রের সম্পদ নিজের সম্পদ মনে করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
১.১০ জীবনযাপনে মিতব্যয়ী ও সুশৃঙ্খল হতে হবে।
১.১১ চিন্তা, কথা ও কাজে সৎ থাকতে হবে।
১.১২ সহপাঠীদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। সদাচরণ করতে হবে।
১.১৩ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে হবে।
১.১৪ অসহায়,দুর্বল, বিপদগ্রস্থ, দুঃস্থ ও রোগীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।
১.১৫ নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাপ্য অধিকার ভোগ করা যাবে। তবে, অন্যের ন্যায্য অধিকার ভোগের সুযোগ দিতে হবে।
২. খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত:
২.১ খাবারের আগে ও পরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
২.২ প্রতিদিন শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। ফলমূল খাওয়ার আগে ভালো করে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
২.৩ বাজার থেকে কেনা ফলমূল, শাক-সবজি বিশুদ্ধ কুসুম গরম পানিতে কমপক্ষে ২০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
২.৪ ধূমপান ও মাদক মৃত্যু ঘটায়। তাই, সবাইকে ধূমপান ও মাদক পরিহার করতে হবে।
২.৫ সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হবে এবং স্যান্ডেল পরে ওয়াশরুমে যেতে হবে। ওয়াশরুম ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। ওয়াশরুম ব্যবহার জানতে হবে। ওয়াশরুম ব্যবহারের পর যথাযথভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
২.৬ ওয়াশরুমে ব্যবহৃত টিস্যু/অন্যান্য পেপার নির্দিষ্ট ঝুড়িতে ফেলতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি ও টিস্যুর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
২.৭ ওয়াশরুম ব্যবহারের প্রয়োজন হলে সংকোচ এবং বিলম্ব না করে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী পৃথক ওয়াশরুম ব্যবহার করবে।
২.৮ রান্না করা খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে, যাতে ধূলাবালি না জমে এবং মশা-মাছি বসতে না পারে।
২.৯ পরিমিত খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত খাবার দেহের ক্ষতি সাধন করে।
২.১০ পঁচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার যতদূর সম্ভব পরিহার করতে হবে। বাইরের অস্বাস্থ্যকর ও খোলা খাবার খাওয়া যাবে না।
২.১১ থালাবাসন ধোয়াসহ পরিবারের সব কাজে টিউবওয়েলের পানি বা বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।
২.১২ সকালে এবং রাতে ঘুমানোর আগে ভালো পেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হবে। একটি ব্রাশ তিন মাসের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। নিয়মিত দাঁতের পরিচর্যা করতে হবে এবং বছরে অন্তত একবার দাঁতের চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
২.১৩ সপ্তাহে অন্তত দু’দিন কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করতে হবে। এতে মুখের ভেতরটা পরিষ্কার হবে ও মুখের দুর্গন্ধ দূর হবে।
২.১৪ ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। নিজ বিদ্যালয় ও বাড়ির আঙ্গিনা এবং বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২.১৫ যেখানে সেখানে কফ বা থুথু ফেলা যাবে না। ঘরের ময়লা নির্দিষ্ট ঝুড়িতে ফেলতে হবে।
২.১৬ আর্সেনিক ও জীবানুমুক্ত পানি পান করতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পাওয়া না গেলে পানি ফুটিয়ে ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করতে হবে।
২.১৭ নিয়মিত খেলাধূলা ও ব্যায়াম করতে হবে।
২.১৮ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পরিধান করতে হবে।
২.১৯ নিয়মিত নখ ও চুল কাটতে হবে।
২.২০ ছয় মাস অন্তর অন্তর কৃমির ওষুধ খেতে হবে। ডাক্তারের পরার্মশ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন করা যাবে না।
২.২১ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য নিকটবর্তী রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
২.২২ প্রয়োজনীয় সব টিকা সময়মতো নিতে হবে।
৩ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সংক্রান্ত:
৩.১ নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে হবে এবং দিনের পড়া দিনে শেষ করতে হবে।
৩.২ জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য অধ্যাবসায়ী ও পরিশ্রমী হতে হবে।
৩.৩ তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে জ্ঞানার্জনসহ যুগোপযোগী শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
৩.৪ জ্ঞানার্জনের জন্য পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বই ও খবর পড়তে হবে।
৩.৫ দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে।
৩.৬ দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করতে হবে।
৩.৭ মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্যদের কাজে সাহায্য করতে হবে এবং নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করতে হবে।
৩.৮ সাঁতার জানতে হবে।
৩.৯ সাবধানে রাস্তা পার হতে হবে এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে।
৩.১০ দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হবে।
৩.১১ বিদ্যালয় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ফুলের বাগানসহ চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৩.১২ বাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করতে হবে।
৩.১৩ বিদ্যালয়ে নিয়মিত অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং সঠিক সুরে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে হবে।
৩.১৪ বিদ্যালয়ে নিয়মিত কাব/স্কাউট সমাবেশ ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে।
৩.১৫ বিদ্যালয়ের কাউন্সিলর শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের বয়ঃসন্ধিকালের সম্যসাগুলোর বিষয়ে আলোচনা/পরামর্শ প্রদান করবেন এবং ছাত্র/ছাত্রীগণ সংকোচ না করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করবে।
৩.১৬ মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
৩.১৭ হাতের লেখা সুন্দর করতে হবে।
৩.১৮ শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী হতে হবে।
৩.১৯. সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অনিয়মকে না বলতে হবে।
৩.২০ বাল্য বিবাহ ও যৌতুককে না বলতে হবে।
৩.২১ স্বেচ্ছাসেবামূলক বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। চিন্তা ও কাজে সৃজনশীল হতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, জেলার রামগতি রায়পুর রামগঞ্জ কমলনগর ও সদর উপজেলায় ২৮টি কলেজ, ১৩৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৪টি মাদ্রাসা, চারটি কারিগরি ও ৭৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য এই নির্দেশনা ফেস্টুন পাঠানো হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী হাসান বলে, পাঠ্য বাইয়ের পাশাপাশি ফেস্টুনের নিদের্শনাগুলো ক্লাসে আমাদের বুঝিয়ে বলেছেন স্যাররা। প্রতিদিন ফেস্টুনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে।
কমলনগরের হাজিরহাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জামাল উদ্দিন বলেন, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য ফেস্টুন রাখা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ফেস্টুনের নির্দেশনাগুলো শিশুদের বুঝিয়ে বলা হচ্ছে। এসব নির্দেশনা মেনে চলতে শিশুরা মনোযোগী হচ্ছে।
চন্দ্রগঞ্জের প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসেন আহমেদ ও রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনজুর কাদের বলেন, ফেস্টুনে থাকা বিষয়গুলো প্রতিদিন ক্লাস ও সমাবেশে আলোচনা করা হয়।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জীবন গড়তে নির্দেশনাগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে জানিয়েছেন রামগঞ্জের কাশিম নগর নূনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. আবদুর রহিম।
হাজিরহাট উপকূল কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মোতালেব বলেন, জীবনাচরণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত আদেশ-নিষেধ সবার মেনে চলা উচিত। এসব বিষয়ে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা সম্বলিত ফেস্টুনটি জেলার মোট ৭৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছেছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা নির্দেশনাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরছেন।
জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী মনে করেন, সুস্থ-সুন্দর আগামী গড়তে এবং প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে শিক্ষার্থীসহ সবারই এসব নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।
শুধু নিজে বড় হলেই হবে না। সমাজ ও দেশের জন্যও কাজ করতে হবে। যে এমনটা করবে তিনিই সম্মানিত হবে, বড় হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৬
এসআই