জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক নির্যাতন (র্যাগিং) চালিয়েই যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের জুনিয়র কর্মী ও সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। প্রায় প্রত্যেকটি হলে পরিচিত হওয়ার নামে গভীর রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে এবং উচ্চস্বরে গালাগাল দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হচ্ছে।
নবীন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসার আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মৌখিকভাবে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান জানান দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশ্য, র্যাগিং দেওয়ার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির রসায়ন বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কান ধরে উঠবস করিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শনিবার (১২ মার্চ) ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেয় রসায়ন বিভাগ পরিবার। নবীন বরণ শেষে ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে জহির রায়হান মিলনায়তনের পেছনের গেটে নিয়ে র্যাগ দিতে থাকে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সেখানে এসে তাদের বিভাগে পাঠিয়ে দেন। এ খবর শুনে দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির তাদের র্যাগ দেওয়ার কারণ জানতে চান এবং শাস্তি স্বরূপ তাদের কান ধরে উঠবস করান। পরবর্তীতে এমন ধরণের কর্মকাণ্ড যেন না করে সেই প্রুতিশ্রুতিও আদায় করেন।
গত রোববার (১৩ মার্চ) গভীর রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীদের হাতে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে রসায়ন বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম অনিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। হলের ছাত্রলীগের জুনিয়র কর্মীরা গণরুমে প্রবেশ করে প্রথম বর্ষের শতাধিক শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে রাখেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অনিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তার সহপাঠীরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান।
একই দিনে (১৩ মার্চ) নতুন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের নতুন কৌশলে র্যাগ দেন ওই বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার উদ্দেশে দুই দফায় বাস ছাড়ে বিকেল ৩টায় এবং ৪টায়। যাদের ৩টার বাস ধরার কথা, তাদের ক্লাসে আটকে রাখা হয় ৪টা পর্যন্ত। আর যারা ৪টার বাস ধরবেন, তাদের আটকে রাখা হয় ৫টা পর্যন্ত। ক্লাস শেষে আটকে রাখায় ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে পারেন না। পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে গিয়ে তারা শিকার হচ্ছেন নানা বিড়ম্বনার।
প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন র্যাগিং গ্রহণযোগ্য নয়।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, র্যাগিংয়ে শিকার হয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী তার সনদপত্র তুলে নিয়ে চলে যেতে চায়। পরে আমরা তাকে বুঝিয়েছি এবং আমাদের বিভাগের দুইজন শিক্ষক সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা ব্যবস্থা নেবেন।
সোমবার (১৪ মার্চ) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বন্ধের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচিতে তারা ‘হলে হলে র্যাগিং চলে প্রশাসন কী করে’, ‘জোট বাঁধ নবীন প্রাণ হোক র্যাগিংয়ের অবসান’, ‘আওয়াজ তোলো তরুণ প্রাণ হোক ৠাগিংয়ের অবসান’, ‘যে তোমার বশ্যতা চায় সে কখনোই বন্ধু নয়’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আনুগত্য তৈরির রাস্তা নয়’, ‘ক্যাম্পাসে থাক স্বাধীন মন আনুগত্য হোক বিসর্জন’, ‘ৠাগিং হল নিপীড়ন এই নিপীড়ন বন্ধ কর’, ‘যে তোমাকে র্যাগ দেয় সে কীভাবে বন্ধু হয়’ শীর্ষক নানা স্লোগান সম্বলিত প্লাকার্ড নিয়ে অবস্থান করেন।
অবস্থান কর্মসূচি শেষে তারা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামে সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। র্যাগিং প্রতিরোধে বিভিন্ন পন্থা নিয়ে উপাচার্যকে পরামর্শ দেন। এ সময় উপাচার্য পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং সবাইকে একযোগে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেন।
এদিকে, র্যাগিং নিয়ে রোববার (১৩ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শৃঙ্খলা বিধি আপডেট করার তাগিদ দেওয়া হয়। এছাড়া বিভাগগুলো ও হলগুলোতে র্যাগিংয়ের বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য বলা হয়।
এ সিদ্ধান্তের পর বিভাগীয় সভাপতি ও হল প্রাধ্যক্ষরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করছেন তা জানতে বাংলানিউজ যোগাযোগ করে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে জুনিয়র ও সিনিয়রদের নিয়ে বসেছিলাম। জুনিয়রদের বলে দেওয়া হয়েছে কোনো ধরনের র্যাগিংয়ের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে জানাতে। সিনিয়রদের বলে দেওয়া হয়েছে জুনিয়দের সঙ্গে কোনো ধরনের অত্যাচার বা র্যাগিংয়ের মত আচরণ করা যাবে না। এমনি আমাদের অনুমতি ছাড়া তাদের নিয়ে কোনো মিটিংও করা যাবে না।
অন্যদিকে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, র্যাগিং প্রতিরোধ করার জন্য আমরা হলের দায়িত্বে যারা আছি, তাদের ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে হলের অফিসারদের বলে দেওয়া হয়েছে সার্বক্ষণিক খোঁজ নেওয়ার জন্য। এছাড়া ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আমার এবং প্রক্টরিয়াল টিমের নাম্বার দিয়ে এসেছি। তাদের বলা হয়েছে কোনো ধরনের র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া মাত্র ফোন অথবা মেসেজ করে আমাদের জানাতে। আমরা জানা মাত্রই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৬
এইচএ/