নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং জনগণ ভীতিহীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সোমবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের তিনি এসব কারণ তুলে ধরেন।
সভায় বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা নির্বাচনে বিএনপির সাতটি আসন পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় ও বিএনপি-জামায়াত জোটের শোচনীয় পরাজয়ের কারণগুলোও তুলে ধরেন তিনি।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে বিএনপি সাতটি আসন পেয়েছে তাদের নিজেদের কারণে। নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের প্রধান কে হবে তা তারা দেখাতে পারেনি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে আপনারা দেখবেন-কংগ্রেসও গত নির্বাচনের আগে দেখাতে পারেনি তাদের প্রধান কে হবেন? তারা মানুষকে ওইভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ঐক্যফ্রন্টের ক্ষেত্রেও তাই-ই হযেছে।
ভোটে পরাজয়ের কারণগুলো তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বিএনপি তাদের জোটে মানবতাবিরোধীদের নমিনেশন দিয়েছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেই দলের ২৫ জনকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনয়ন দিয়েছে, এজন্য তাদের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে।
‘আর বিএনপির মূল লিডাররা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত এবং আদালতের রায়ে অভিযুক্ত। তাদের একজন কারাগারে ও অন্যজন পলাতক। সুতরাং তাদের মূল নেতৃত্বের অভাব ছিলো। পরাজয়ের এটিও একটি কারণ। ’
মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিএনপির অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। তারা টাকার বিনিময়ে অর্থাৎ যে টাকা বেশি দিয়েছে তাকেই নমিনেশন দিয়েছে, যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়নি।
‘একেকটা আসনে চারজন, পাঁচজন ও তিনজন করে নমিনেশন দিয়েছে। এতে কেউ আর ওইভাবে মাঠে কাজ করেনি। কে কী করবে, না করবে না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ও হতাশায় কেউ কাজ করেনি,’ যোগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনা বলেন, নির্বাচন হলে মানুষ চিন্তা করে কে প্রধানমন্ত্রী হবে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট কাউকে সেভাবে জাতির সামনে দেখাতে পারেনি। ফলে তারা ওইভাবে ভোটারদের আকর্ষণও করেতে পারেনি।
তিনি বলেন, আইনজীবী হিসেবে কামাল হোসেন খুবই ভালো। কিন্তু তিনি যখন তার দল গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন তখন থেকেই তার নির্বাচন পরিচালনা করার ভালো অভিজ্ঞতা নেই, জেতারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে বিএনপি আমলে দুর্নীতির কথাও তুলেন ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘বিএনপি আমলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা ইত্যাদি কারণে মানুষ তাদের রিজেক্ট করেছে। ’
‘আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি- তারা (বিএনপি-জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্ট) নির্বাচনী কোনো কাজ করেনি। কয়েকজনের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও অনেকেই অ্যাক্টিভিটি না করে প্রোপাগান্ডা ছাড়া সেরকম কিছু করেনি,’ বলেন শেখ হাসিনা।
সভায় নির্বাচন ও জয় পাওয়ার বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। শেখ হাসিনা বলেন, এই নির্বাচনটা খুবই শান্তিপুর্ণ হয়েছে। এর আগে কখনও এতটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ।
‘এই নির্বাচনে আমাদের জনগণ অবাধে ও ভীতিহীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েছে নির্বাচনে। এতে আমাদের দলের কিছু কর্মীও মারা গেছে। এজন্য আমরা দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করছি। ’
এ সময় আওয়ামী লীগ আমলে দেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশজুড়ে অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ছাড়াও ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। বিগত বছরগুলোতে মানুষ অধিকতর ভালো জীবন-যাপন করেছে। এজন্য তারা আমাদের ভোট দিযেছে।
এ সময় বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষার প্রসার, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেছে। এজন্য তরুণরাও আকৃষ্ট হয়ে আমাদের ভোট দিয়েছে।
গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে আওয়ামী লীগের ত্যাগ ও অবদানের কথা তুলে ধরে গণতন্ত্রমনা শেখ হাসিনা বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচনী ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য নির্বাচন কমিশনকে একটি সাংবিধানিক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তও দিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র অগ্রসর হচ্ছে। অতীতে মিলিটারি ডিক্টেটররা ক্ষমতায় বসেছে। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্ট থেকে। আমি-ই একমাত্র ব্যক্তি যে কি-না ক্যান্টনমেন্ট থেকে না এসে দেশ পরিচালনা করছি।
‘গণতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ উন্নতি করতে পারেনি। আমি সব সময়-ই চিন্তা করেছি, জনগণ ভোট দিলে (ক্ষমতায়) থাকবো, অন্যথায় থাকবো না। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতেই হবে এ চিন্তা কখনও করিনি। ’
বিরোধীদের নিরাপত্তা বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খ্যাত শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হই তখন সকল মানুষই প্রধানমন্ত্রী। সবাইকে সুরক্ষা দেওয়া আমরা দায়িত্ব। ভোটের অধিকার মানুষের, ভোট দেওয়ার সময় মানুষ যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। কিন্তু ভোটের পর সবাই সমান।
ভোট শুরুর আগেই ব্যালটবক্সের মধ্যে সিল মারা ব্যালট থাকা একটি ভিডিও সম্প্রচারিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বিবিসির এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই ব্যালট ভর্তি বাক্সের ফুটেজটি ৩০ ডিসেম্বরের ছিল না। এটি ছিল মেয়র নির্বাচনের সময়কার, যে বাক্সটি তখন ভোট গণনার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে বিশ্বাস করেন না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এগুলো অতিরঞ্জিত এবং পুরনো ছবি।
তিনি জানান, যেখানেই কোনো অভিযোগ উঠেছে এবং তাদের গোচরে এসেছে নির্বাচন কমিশন সেখানেই তৎক্ষণাৎ ভোট গ্রহণ বন্ধ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরকম কিছু ঘটে থাকলে সেখানে স্থগিত হয়ে যেত।
অনেক বিদেশে পর্যবেক্ষকদের ভিসা দেওয়া হয়নি আল জাজিরার সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। তারা যাদের মনে করেছে তাদের দিয়েছে।
আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে টানা তিনবার মিলিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সন্ত্রাস, মাদক ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি থাকবে আমাদের। মানুষকে সুরক্ষা দিবো। আমরা আমাদের উন্নয়ন কাজগুলো চালিয়ে যাবো। নতুন নতুন উন্নয়ন করবো।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম, প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ এ আরাফাত।
পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কানাডা, নেপাল, ভারত, জিম্বাবুয়ে, ওআইসি, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, আল-জাজিরা, এনডিটিভিসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮/আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা
এসকে/এমইউএম/এমএ