ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন

নগরকান্দা থেকে আদিত্য আরাফাত

‘মামাই ভরসা’

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
‘মামাই ভরসা’ ছবি: রাজিব/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফরিদপুর নগরকান্দা থেকে: ‘মামা যাকে চাচ্ছেন তিনি হবেন মেয়র, আগেও তাই হয়েছে’ বললেন ফরিদপুর নগরকান্দার নিজাম নামের একজন ভোটার।

নিজেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দাবি করে এ পৌর বাসিন্দা বলেন ‘খোকন রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর এখানে যে উপ-নির্বাচন হয়েছে, তাতে মামার সমর্থন পেযে ৮ মাসের জন্য যিনি মেয়র হয়েছেন এবারও তিনি প্রার্থী।

মামা এবারও তার জন্য কাজ করছেন। ’

উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে কয়েকজনের মুখেও শোনা গেলো ‘মামা’ সম্বোধনটি। উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতৃবৃন্দদের ‘মামার নেতৃত্বে কাজ করবো’ বলে বক্তব্য দিতেও দেখা গেছে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, নগরকান্দার উপজেলায় আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলুকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এলাকার বাসিন্দারা ‘মামা’ বলেই সম্বোধন করেন। সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে হওয়ার কারণে আয়মনকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করা হয়। আয়মন নগরকান্দা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

পৌর বাসিন্দারা বলছেন, সাজেদা চৌধুরীর ছেলে আয়মন নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থী রায়হান উদ্দীনের পক্ষে কাজ করছেন। অন্যদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী দলের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুর রহমান মুকুলের পক্ষে রয়েছেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শ্যামা ওবায়েদ।

দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নগরকান্দা পৌর যুবলীগের সভাপতি মো. মুরাদ হোসেন বিকুল মেয়র পদে প্রার্থী হলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এ বিদ্রোহী প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করায় শনিবার উপজেলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নীতি নির্ধারণী এক জরুরি সভায় দল তাকে বহিষ্কার করে।

জানা গেছে, বিকুল তার সমর্থিত পৌর আওয়ামী লীগের একাংশকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবেন।

এলাকাবাসীর মতে, এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর মধ্যেই চলবে ভোট যুদ্ধ। কারো কারো মতে এটা ‘সেয়ানে সেয়ানে টক্কর। ’

দল থেকে মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে যারা কাজ করছেন, তারা জয়ে আশাবাদী। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীর সমর্থিতরাও বলছেন,‘নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিজয় সুনিশ্চিত। ’ হাল ছাড়ছেন না অবশ্য বিকুল সমর্থিতরাও।

নির্বাচনের এমন উত্তাপে চায়ের কাপে এখন কেবল ভোটের ঝড়। নগরকান্দা পৌরসভা সংলগ্ন এলাকায় চায়ের চুমুকে এমন আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলাকালীন কথা হয় কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে।

নির্বাচনের হাল-অবস্থা জানতে চাইলে মো. লোকমান নামে ৩নং ওয়ার্ডের একজন ভোটার বলেন, ‘সুষ্ঠু হলে বিএনপির প্রার্থীর জয় নিশ্চিত। ’ তার বক্তব্য, ‘৬ মাস আগে উপজেলায় যে নির্বাচন হয়েছে তাতে ৯০ ভাগ লোকই ভোট দিতে পারেনি। আমি নিজেও ভোট দিতে পারিনি। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ারও অবস্থা ছিলো না। ’

তিনি বলেন, ‘মামার নামতো শুনেছেন, তিনিই যাকে চেয়েছেন তিনি হয়েছেন। এবারও মামা যদি চান আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে যেকোনো প্রকারে জেতাতেই হবে, তাহলে সাধারণ মানুষের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। ’

তার এমন কথায় সমর্থন দিয়ে আরেকজনও প্রায় একই বক্তব্য দিয়েছেন। তবে দু’জনের কথার বিরোধিতা করে মামুনের আরেকজন বলেন, ‘উপ নির্বাচনে দু-একটি কেন্দ্রে ভোট কারচুপির অভিযোগ থাকলেও সব কেন্দ্রেতো বিশৃঙ্খলা হয়নি। ওই নির্বাচনের উদাহরণ টেনে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন সুষ্ঠু হয় কি-না তার প্রশ্ন তোলা এখন তো ঠিক নয়। এখন পর্যন্ততো নির্বাচনের প্রচারণায় কোনো বিশৃঙ্খলাই হয়নি। বিএনপির প্রার্থী খোলা মাঠেই প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কোনো বাধা দেয়নি। ’

সাজেদা চৌধুরী পুত্র আয়মনকে ‘মামা’ সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘উনি বুঝতে পারছেন যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীই জিতবে। উপজেলার আ.লীগের সভাপতি যেহেতু দলের প্রার্থী, তার দিকে নজর রাখতে হয়। ’

এ ভোটারের মতে, ‘মামা যা করেন দলের স্বার্থেই করেন। মামাই নগরকান্দার ভরসা। ’
পৌর এলাকায় বিএনপির ওয়ার্ড নেতা ও কর্মীরা মনে করছেন, উপজেলায় চলতি বছরের ৬মে উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। সে আশঙ্কা আসন্ন নির্বাচনেও তারা করছেন বলে জানালেন।

তবে নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও সুষ্ঠু ভোট হলে নির্বাচনের শেষ হাসি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীই হাসবেন বলে তারা মনে করেন।

নির্বাচনের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, নগরকান্দা পৌরসভার এ নির্বাচনে বিএনপি হতে একক প্রার্থী হওয়ায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি দলীয় প্রার্থী। অপরদিকে বহিষ্কার করা হলেও নিজ দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বিপাকে রয়েছে আওয়ামী লীগ। আসন্ন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর হতে এখন পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ হতে এখানে নির্বাচনী অনিয়মের কোন অভিযোগ উঠেনি।

তবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দের পক্ষ হতে শঙ্কা প্রকাশ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দাবি করা হয়েছে।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নগরকান্দা পৌরসভার তৃতীয় বারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে মেয়র খোকনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মামলা হয়। এ মামলা হওয়ার পর তিনি আত্মগোপন করেন। পলাতক অবস্থায় মানবতাবিরোধী মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াত ঘনিষ্ঠ খোকন বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান জিয়াউর রহমানের আমলে। সর্বশেষ নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি হন। সেই সূত্রে ২০১১ সালে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

দীর্ঘদিন মেয়র খোকন পলাতক থাকায় গত ৫ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পৌরসভা বিভাগ নগরকান্দা পৌরসভার মেয়রের পদটি শূন্য হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ৬ মে’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী্ রায়হান উদ্দিন মিয়া জয়ী হলেও স্থানীয় বিএনপির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কার্যা্লয় থেকেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। রায়হান বর্তমানে পৌরসভার মেয়র।

শনিবার নির্বাচনের প্রচারণাকালীন কথা হয় বর্তমান মেয়র ও আসন্ন পৌর নির্বাচনে এ পদের প্রার্থী সত্তরোর্ধ রায়হান উদ্দিন মিয়ার সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। আওয়ামী লীগ থেকে আমিই মনোনীত। ’

এর আগের নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব অপবাদ। জয় এর আগেও হয়েছে, সামনেও হবো। ’

‘মামার সমর্থনতো আছেই’ এমন কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘হ্যা, তাতো আছেই।

এদিকে পৌর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, উৎসবমুখর পরিবেশে পৌর নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের পর মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতীক নিয়ে পাড়া মহল্লায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। পৌর এলাকার সর্বত্রই এখন নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে।

নগরকান্দা পৌরসভার একবারের নির্বাচনে মেয়র পদে ৩ জন, সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৮ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৩২ জনসহ মোট ৪৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রার্থীরা প্রতীক বরাদ্দের পরপরই তাদের পোস্টার পৌর শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে প্রচারণায় প্রার্র্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় প্রতীকের জানান দিচ্ছেন ও ভোট প্রার্থনা করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
এডিএ/আরআই

** নাম তার ‘মেঝভাই’
** ‘এবার জোয়ান বুড়ার লড়াই’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।