জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। কাজের বাইরেও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়েও কথা বলতে দেখা যায় তাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন ফারুকী। গণঅভ্যত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও সেই ধারাবাহিকতা অব্যহত রেখেছেন। চলমান নানা ইস্যু নিয়ে নিয়মিত নিজের মতামত ও পরামর্শ দিচ্ছেন।
চলচ্চিত্রবিষয়ক পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন তিনি। বুধবার (৯ অক্টোবর) এক ফেসবুকে স্ট্যাটাস ফারুকী লেখেন, চলচ্চিত্র বিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে, তার মধ্যে পরামর্শক কমিটিই আমার বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। বাকি কমিটিগুলোতে যোগ্য লোক যেমন আছে, কিছু বিস্ময়কর নামও আছে। এই সমালোচনাটা করে রাখা দরকার যাতে সরকার বুঝতে পারে। না হলে আগের আমলের মতো ‘কর্তা যা করেছেন মাইরি’ সিচুয়েশন বানিয়ে ফেলব আমরা।
কয়েকজন নির্মাতার নাম উল্লেখ করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, আমার বিবেচনায় এখানে আরও কিছু অংশীজন থাকা উচিত ছিল। যেমন ফাহমিদুল হক, বিধান রিবেরু, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মেজবাউর রহমান সুমন, নুহাশ হুমায়ুন। স্বচ্ছতার জন্য বলে নেওয়া ভালো আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল পরামর্শক এবং আরেকটা কমিটিতে থাকার জন্য। আমি ব্যক্তিগত কারণে থাকতে চাইনি। এখন যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা থাকতে অপারগতা জানিয়েছেন কিনা আমি জানি না।
কমিটিতে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের ব্যাখ্যা করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, আমার বক্তব্য থাকবে, এই পরামর্শক কমিটি থেকে পরামর্শ যা যাবে তা যেন অংশীজনরাই তৈরি করে দেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল এক্সিকিউশনের দিকটা দেখা উচিত। নীতি প্রণয়নে তারা হাত না দেওয়াই ভালো হবে। কারণ তারা তো আমাদের সমস্যা এবং প্রয়োজনটা জানেন না।
একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন উল্লেখ করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, রেভিনিউ শেয়ার এবং ই-টিকিট নিয়ে কথা বলেছি। ফলে ওটা রিপিট করছি না এখানে। এখানে আরেকটা কথা যোগ করতে চাই। শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে মোটামুটি দেশ জুড়েই। কমপক্ষে ৩০ জেলায় শিল্পকলার জায়গায় মাল্টিপ্লেক্স করে সেটা দরপত্রের ভিত্তিতে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু আমাদের জাতিগত দুর্নাম ‘আমরা শুরু করি, অব্যাহত রাখি না’, সেহেতু এই সব মাল্টিপ্লেক্সকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে এর মেইনটেনেন্স ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। না হলে লিজ বাতিলের শর্ত থাকতে হবে। এখন ঝামেলা হলো শিল্পকলা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর সিনেমা-টিভি-ওটিটি তথ্য ও সম্প্রচারে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে হলেও এটা করা দরকার।
অনুদান প্রথাতে আমূল পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি লেখেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হচ্ছে ফিল্ম ফাণ্ড এবং সাপোর্ট সিস্টেম। আমাদের সামনে বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের উদাহরণ আছে। আমি মনে করি, পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান প্রথাতে আমূল পরিবর্তন আনা। ৫০ ভাগ সিনেমা ফার্স্ট অ্যান্ড সেকেন্ড টাইম ফিল্মমেকারদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। এই ৫০ ভাগের মাঝে কমপক্ষে অর্ধেক নারী ফিল্মমেকারদের জন্য থাকা উচিত। তো এই নতুন পরিচালকদের স্রেফ ফাণ্ড দিয়েই হাত গুটিয়ে ফেলা যাবে না। স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে লোকাল এবং ইন্টারন্যাশনাল মেন্টর দিয়ে এদের সহায়তা করতে হবে।
কোন ধরনের সিনেমাকে অনুদান দেওয়া উচিত, তার একটি রূপরেখা জানিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, আমাদের অনুদান পলিসি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। আমরা কোন ধরনের সিনেমাকে অনুদান দিব? ইরানের মতো সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট এবং ইমপ্যাক্টফুল স্টোরিটোলিং? নাকি কলকাতা আর্টহাউজের দুর্বল ফটোকপি? নাকি বেলা তারের মতো সিনেমা? আমার বিবেচনা হচ্ছে, আমাদের এখানকার মানুষ, তাদের সম্পর্ক, আবেগ, পাগলামো এসব মিলিয়ে আমাদের আশেপাশে নিজস্ব গল্প এবং চরিত্রেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এইসব নিয়ে সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট সিনেমার সংখ্যা বাড়লেই আমরা সত্যিকারের বাংলাদেশি নিউ ওয়েভ হতে পারব।
দেশের ফ্যাসিবাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অনুদান কাজে লাগানোর কথা স্মরণ করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, আবার অন্য একটা প্রসঙ্গও আছে। লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসন এবং দুঃশাসন আপনি খুঁজে পাবেন তাদের সাহিত্যে-সিনেমায়। আমাদের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদের কাল তুলে ধরার কাজে এই অনুদান কাজে লাগানো যায় কিনা দেখতে হবে। তবে আওয়ামী যুগের মতো স্লোগান সর্বস্ব যেন না হয়, খেয়াল রাখতে হবে। একইসঙ্গে পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান কমিটি পুনর্গঠন করা। নতুন পলিসির আলোকে যারা এটা এক্সিকিউট করতে পারবে তাদের রাখা উচিত। দেখেন ব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনুদান কমিটির সমালোচনা করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, এখন যে অনুদান কমিটি করা হয়েছে সেখানে এক দুইজন যোগ্য লোক থাকলেও এটা অনেকটাই আওয়ামী লীগ আমলের মতোই ব্যাকডেটেড কমিটি। আর এই কমিটির কে কীভাবে ফ্যাসিবাদের কালচারাল উইংয়ের ফুটসোলজার ছিল সেই আলাপে গেলাম না। আমি মনে করি, এই কমিটিতে থাকা উচিত ছিল তাদের, যাদের সারা দুনিয়ায় এই কাজগুলো কীভাবে হচ্ছে সেটার ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা আছে। বিদ্যমান কমিটির যোগ্য দুয়েকজনের পাশাপাশি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, নুহাশ হুমায়ুন, আরিফুর রহমান, তানভীর হোসেন, সালেহ সোবহান অনীম, আদনান আল রাজীব, কামার আহমেদ সায়মন, হোমায়রা বিলকিস এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ থাকলে আমরা একটা ফরওয়ার্ড লুকিং ভিশন পেতাম।
ব্যক্তির ওপরে গুরত্ব দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন, অনেকে ভাবতে পারেন আমি ব্যক্তির ওপর কেন গুরুত্ব দিচ্ছি। দিচ্ছি কারণ ব্যক্তির কারণেই আকাশ পাতাল পার্থক্য রচিত হয়। মোহাম্মদ আযম আর মিডিওকার কোনো রাম-শ্যাম এক জিনিস না। সৈয়দ জামিল আহমেদ আর লাকী এক জিনিস না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২৪
এনএটি