ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

কান উৎসবের খুঁটিনাটি

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট... কান (ফ্রান্স) থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৪ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
কান উৎসবের খুঁটিনাটি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরবর্তী শহর কানে আজ বুধবার (১৩ মে) শুরু হচ্ছে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৬৮তম আসর।

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী এই আয়োজনকে ঘিরে কান হয়ে ওঠে মুখর।

১৯৪৬ সাল থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের শৈল্পিক অর্জনগুলো উদযাপনের জন্য প্রতি বছর এই উৎসব হয়ে থাকে। বর্তমানে চলচ্চিত্রে আর্ন্তজাতিক প্রভাব ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে আয়োজনটি। উৎসবের একদিকে যেমন থাকে শৈল্পিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছবি, পাশাপাশি দেখা যায় বিখ্যাত তারকাদের জাঁকালো পোশাকের আলোয় উজ্জ্বল লালগালিচা।

কান উৎসবকে ঘিরে এবারও সারাবিশ্ব থেকে বাঘা বাঘা সব চলচ্চিত্র পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীর ভিড় জমেছে ফ্রান্সের কান শহরে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই চলচ্চিত্র উৎসবটির একটি ইতিহাস রয়েছে। জেনে নিন এ উৎসবের ইতিহাসের খুঁটিনাটি কিছু তথ্য।

শুরুর কথা
১৯৩০ সালে ফরাসি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফিলিপ এরল্যাঙ্গার ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী জি. জেই’র কাছে এমন একটি উৎসবের জন্য সুপারিশ করেন। পরে ফরাসি শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরে আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় শুরু হয় এই আয়োজন। এর প্রথম আসর বসে ১৯৩২ সালে। তবে কানে নয়, এটি হয়েছিলো ইতালির ভেনিস শহরে। তাই এর নামও কান চলচ্চিত্র উৎসব ছিলো না। শুধুই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব নামে এটা পরিচিত ছিলো। কিন্তু ১৯৩৮ সালে পুরস্কারের বিষয়ে ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার হস্তক্ষেপ করায় উৎসব আয়োজনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই পরের বছর কানে উৎসবটি হয়। এরপরই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ কারণে মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৪৬ সালে আবার এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়। ১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ফেস্টিভ্যাল দু ফিল্ম ডি কান নামে উৎসবটি হয়। এর পর্দা নামে ৫ অক্টোবর। এটাই ছিলো কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসর। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালে উৎসবটি হয়নি। অবশ্য ততোদিনে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক উৎসবের মর্যাদা পেয়ে গেছে এটি। ১৯৫৫ সালে ফ্রান্সের কান শহরকে স্থায়ীভাবে এ উৎসব আয়োজনের কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়।


উৎসবের বিবর্তন
১৯৬৮ সালে ২১তম কান চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তৎকালীন ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জ্যঁ লুক গদার ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর নেতৃত্বে একদল তরুণ নির্মাতা মঞ্চের পর্দা ধরে ঝুলে পড়ে মাঝপথে বন্ধ করে দেয় উৎসব। এ কারণে পরের বছর থেকে শুরু হয় দুটি উৎসব। প্রচলিত উৎসবের পাশাপাশি শুরু হয় পিয়েরে অঁরি ডিলিউর নেতৃত্বে বিশিষ্ট পরিচালকদের উদ্যোগে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট, এর পুরোটাই ছিলো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দখলে। ১৯৬২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক নামে উৎসবের আরেকটি অংশ চালু হয় ফ্রেঞ্চ ইউনিয়ন অব ফিল্ম ক্রিটিকসের হাত ধরে। তারা অবাণিজ্যিক নবীন পরিচালকের প্রথম অথবা দ্বিতীয় কাজকে পুরস্কার দিয়ে মূল্যায়ন করেন। ১৯৬৫ সালে ফরাসি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জ্যঁ ককতোকে সাম্মানিক সভাপতি ঘোষণা করা হয়। সত্তরের দশকে কান উৎসবে বেশকিছু পরিবর্তন আসে। মরিস বেসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে ছবি বাছাইয়ের নীতিতে পরিবর্তন আনেন। আগে যেখানে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ নিজেরাই ঠিক করতো কোন ছবি যাবে, বেসি সেখানে নতুন দুটি কমিটি তৈরি করেন যারা যাচাই-বাছাই করে ফরাসি ও অন্যান্য দেশের ছবি নির্বাচন শুরু করেন। এ ছাড়া সিনেফন্ডোশন নামে উৎসবের আরেকটি শাখা তৈরি হয় যা বিশ্বের বিভিন্ন ফিল্ম স্কুলের কাজসমূহকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পুরস্কারের গল্প
কান উৎসবের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হলো স্বর্ণপাম। এর বিজয়ী নির্বাচিত হয় প্রতিযোগিতা বিভাগেরে ছবিগুলো থেকে। এগুলো প্রদর্শন করা হয় থিয়েটার লুমিয়েরে। পুরস্কারটির বর্তমান নকশা অনুযায়ী এতে থাকে ২৪ ক্যারেট সোনা। শুধু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য রয়েছে শর্টফিল্ম পাম দ’র পুরস্কার এসব ছবির প্রর্দশীন হবে বুনুয়েল ও ডেবাসি থিয়েটার হলে। এ ছাড়া কানে রয়েছে উৎসব বহির্ভূত সংগঠনগুলোর আয়োজনে কয়েকটি বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে ডিরেক্টরস্ ফোর্টনাইট  ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস্ উইক বিভাগ দুটি। এখানে নির্বাচিত পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগেুলোর মধ্য থেকে দেওয়া গ্র্যন্ড প্রিক্স পুরস্কার। এখানকার পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিগুলোকে সেরা চিত্রনাট্যের জন্যদের দেওয়া হয় প্রিক্স দু সিনারিও।

চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সিনেফাউন্ডেশন বিভাগ। সারাবিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র স্কুল থেকে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী তাদের ছবি প্রদর্শনের জন্য এখানে আবেদন করেন। এর মধ্য থেকে নির্বাচিত স্বল্পদৈর্ঘ্য বা তারও কম দৈর্ঘ্যের ছবিগুলো সেল বুনুয়েল প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়। এর মধ্যে থেকে সেরা তিনটি চলচ্চিত্র সিনেফাউন্ডেশন জুরিদের নির্বাচনে পুরস্কার পায়।

টুকরো তথ্য
* কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল নাম ফেস্টিভ্যাল ডি কান। ২০০২ সালে এই নাম অনুমোদিত হয়।

* পালে দ্য ফেস্টিভালে দ্য কোঁগ্র ভবনে মূল উৎসব হয়ে থাকে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এটাকেই বলা চলে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। শুধু কান উৎসবের জন্যই এই ভবন গড়ে তোলা হয়েছিলো। এটি ১৯৮৩ সালে আরও জাঁকালোভাবে নির্মাণ করা হয়। ফরাসিরা আদর করে এর নাম দিয়েছে ‘দ্যা বাংকার’।

* পোলিশ পরিচালক কার্জসটফ কিয়েসলস্কি তার ‘থ্রি কালারস’ ট্রিলজির (দ্য থ্রি কালারস ট্রিলজির ‘রেড’বানিয়েছিলেন কান উৎসবকে উদ্দেশ্য করে।

* ১৯৫০ সালের পর প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হচ্ছে এই উৎসব। শুরুর দিকে এটি আয়োজনের কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিলো না। ১৯৬৭ সালের পর থেকে প্রতি বছর মে মাসে অর্থাৎ ফরাসি বসন্তে আয়োজন করা হয় কান উৎসব। ১২ দিন ধরে চলে এটি।

* কান উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ‘রেড কার্পেট’। এবারও বিশ্বের নামি-দামি তারকারা লালগালিচা মাড়িয়ে উৎসবে যোগ দেবেন। এর দু’পাশে সাংবাদিকরা ভিড় করে থাকেন তারকাদের ছবি তোলার জন্য। ২২ গজের লাল রঙা কার্পেটটি দিনে তিনবার পরিবর্তন করা হয়।

* কান উৎসবের জন্য প্রতি বছর বাজেট থাকে প্রায় ২ কোটি ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় ২০০ কোটি টাকা। এর অর্ধেক আসে বিভিন্ন পাবলিক ফান্ড থেকে। বাকিটা পাওয়া যায় অফিসিয়াল পার্টনার এবং গ্রুপ থেকে।

* প্রতি বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, প্রতিনিধি, ভক্ত- সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের সমাগম হয়।

* ২০১৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে মোট ৩ হাজার ৭৬৭ জন সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। ফলে অলিম্পিকের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায় এই আয়োজন।

* কান চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালে শহরটির বিভিন্ন হোটেলে প্রধান খাবারের জন্য দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৩৫ ইউরো।

* কান শহরের হোটেলগুলোর বার্ষিক আয়ের ১৫ শতাংশ আয় হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবের ১২ দিনে।

* কান উৎসবে দুয়োধ্বনি পাওয়া কয়েকটি ছবি পরবরতীতে অনন্য সৃষ্টির খেতাব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাইকেল আন্তোনিওনির ‘লা আভেন্তুরা’ (১৯৬০), ট্রাফাউটের ‘লা পিয়াউ ডউস’ (১৯৬৪) এবং রবার্ট ব্রেসন্সের ‘লা আর্জেন্ট’।

* ১৯৫৫ সালে প্রবর্তিত স্বরণপাম তথা পাম দ’র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে পুরস্কারের নামকরণ করেছেন। যেমন ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিনের তত্ত্বাবধানে পাম ডগ নামক একটি পুরস্কার প্রদান করা হয় যেটি দেওয়া হয় কুকুর সম্বন্ধীয় চলচ্চিত্রের জন্য। লিঙ্গ সম্পর্কিত ছবির জন্য দেওয়া হয় কুয়ার পাম। আর পর্নোগ্রাফি ছবিকে দেওয়া হয় হট পাম পুরস্কার।

* কান চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা হচ্ছে ‘সিনেমা ডি লা প্লাজ’। এই বিভাগ শুধুই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য। উৎসবে যতো স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় (কান ক্ল্যাসিকস-সহ) তা এ বিভাগের মাধ্যমে ‘ম্যাস বিচে প্রদর্শিত হয়। এসব দেখতে দর্শককে অবশ্যই টিকিট কিনতে হয়।

বাংলানিউজে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে www.rabbitholebd.com এর সৌজন্যে।

ফ্রান্স সময় : ০৩২৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
জেএইচ

** কানে চোখ রাখুন
** প্যারিসে এক টুকরো কান
** রোড টু কান

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।