সৈয়দ হাসান ইমাম অভিনেতা পরিচয়ের পাশাপাশি স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। আগামীকাল ২৭ জুলাই বরেণ্য এই শিল্পীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী।
এ উপলক্ষে বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ‘শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমামের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন পর্ষদ’। পর্ষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি কামাল লোহানী। এর সদস্যসচিব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, তারা বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে ‘নীল ছোঁয়া কিংবদন্তি’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানে হাসান ইমামকে শুভেচ্ছা নিবেদনের জন্য মানপত্র লিখেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। অনুষ্ঠানে সৈয়দ হাসান ইমামের ওপর লেখা ‘নীল ছোঁয়া কিংবদন্তি’ শিরোনামে একটি সম্মাননা বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হবে। এ ছাড়া থাকছে তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, গান, নাচ ও আবৃত্তি।
সৈয়দ হাসান ইমামের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ জুলাই, ভারতের বর্ধমানে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, পরিচালক হিসেবেই পরিচিত তিনি। ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্রে এবং ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন তিনি। ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় উৎসবে ডামা সার্কেল প্রযোজিত ‘তাসের দেশ’, ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন হাসান ইমাম।
বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নাটকে নিয়মিত অংশ নেন হাসান ইমাম। তার অভিনীত দুই শতাধিক টিভি নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’, মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত ‘স্বপ্ন বিলাস’ ইত্যাদি।
অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনাও করেছেন হাসান ইমাম। তার পরিচালিত নাটকের তালিকায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, সোমেন চন্দের ‘না’ ইত্যাদি। এর মধ্যে ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় বাংলা একাডেমীর বটমূলে সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ‘রক্তকরবী’ নাটকটি সাড়া ফেলেছিলো।
হাসান ইমাম অভিনীত প্রথম দিকের ছবির মধ্যে ‘রাজা এলো শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘জানাজানি’, ‘ধারাপাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। খান আতাউর রহমানের ‘অনেকদিনের চেনা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৬৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান লাভ করেন হাসান ইমাম।
দেশেও সেরা অভিনেতা ও সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন সৈয়দ হাসান ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য পান সিকোয়েন্স পুরস্কার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন।
হাসান ইমামের জীবনের ১০ ঘটনা
* হাসান ইমাম মাত্র দুই বছর বয়সে তার বাবাকে হারান।
* পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন হাসান ইমাম। তার ব্যাংকে নিয়মিত যেতেন নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসানের বাবা। মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর হাসান ইমামের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন তিনি।
* মাত্র ১৬ বছর বয়সে বর্ধমান জেলা গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ হাসান ইমাম।
* ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালে অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথম স্থান পান হাসান ইমাম। বর্ধমানে মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসিত হন তিনি। ১৯৫৫ সালে কলেজের অনুষ্ঠানে তার গান শুনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তাকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মাত্র এক বছর তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তামিল নেন।
* ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন হাসান ইমাম। ১৯৬৬ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি।
* ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করেন তারা। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
* ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মুজিবনগরে চলে যান হাসান ইমাম। মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্যবিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন তিনি। সংবাদ পাঠ এবং নাট্যবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
* মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিবনগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
* জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রধান মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র আহ্বায়কের দায়িত্ব পান সৈয়দ হাসান ইমাম। ২০০১ সালে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ বহু সংগঠনের সভাপতি-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
* দীর্ঘ ৩৮ বছর টেলিভিশন নাট্যকার, নাট্যশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন হাসান ইমাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা চক্রান্তের ওপর রচিত আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ পরিচালনার কাজেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এটি তার নির্দেশনায় সফলভাবে মঞ্চায়িত হয় ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ লন্ডনের লোগান হলে।
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
জেএইচ