ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

কলকাতা থেকে জনি হক

হিন্দি গান গাইলেনই না রুনা লায়লা

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
হিন্দি গান গাইলেনই না রুনা লায়লা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লেখাটার শিরোনাম হতে পারতো আরও মেলা কিছু। হতে পারতো- গানে গানে কলকাতা মাতালেন রুনা লায়লা।

এ আর এমন কি! এর আগেও অনেকবার কলকাতা মাতিয়েছেন তিনি। তাছাড়া তিনি গাইবেন আর দর্শক-শ্রোতা মাতবে না তা কি করে হয়! আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই কণ্ঠশিল্পীর পরিবেশনা শেষেই টিপটিপ বৃষ্টি ঝরতে লাগলো কলকাতায়। শীত ঋতুতে এ দৃশ্য বিরল। সে সূত্র ধরে শিরোনাম হতে পারতো- রুনার সুরের মূর্ছনায় নামলো বৃষ্টি। এটাও অস্বাভাবিক মনে হলো না! এমন সুরেলা কণ্ঠ যার, তিনি গলা ছেড়ে গাইলে বৃষ্টি না নেমে পারে কীভাবে! এমন আরও বেশ কয়েকটা শিরোনাম মাথায় এলো।
 
কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে পশ্চিমবঙ্গের দর্শক-শ্রোতার আলাদাভাবে মনে থাকবে একটি দিক। সেটা তাদের জন্য বড়ই হতাশার! তা হলো রুনার হিন্দি গান না গাওয়া। নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন আয়োজিত বাংলাদেশ বিজয় উৎসবের তৃতীয় দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। ফলে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি আগের দু’দিনের তুলনায় দেখা গেলো দ্বিগুণ। তাদের বেশিরভাগেরই প্রত্যাশা ছিলো, ‘ও মেরা চেইল চেবিলা ম্যায় তো নাচুঙ্গি’, ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ শোনা হবে।
 
মঞ্চে এসে বাংলা গানেই মন ভরাতে লাগলেন রুনা। মাঝে বিখ্যাত গান ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ গাওয়ার ভুরি ভুরি প্রস্তাব আসছিলো। এটা স্বাভাবিকই। এই গান গেয়েই সাধারণত নিজের সব কনসার্টের ইতি টানেন তিনি। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে বাংলার মতো হিন্দিও গ্রহণযোগ্য। এটাই তাদের রাষ্ট্রভাষা। তাদের এই চাহিদা অমূলক কিছু নয়। তাছাড়া রুনাও দর্শকদের অনুরোধ সাধারণত ফেলেন না। আন্তরিকতার সঙ্গেই সব পূরণ করেন। তার বিভিন্ন কনসার্ট থেকে এটাই দেখেছি। কিন্তু এদিন নতুন অভিজ্ঞতা হলো। তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘আজ এ গান হবে না। আজ শুধু বাংলা। ’ কিছুক্ষণ পর আরও একবার তার কাছে অনুরোধ গেলেও তিনি জোর গলায় না বলে দেন।
 
রুনা যে এমন করবেন তার আঁচ পাওয়া গেছে শুরুতেই। মঞ্চে এসেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি পরিবেশন করেন ‘দেশের জন্য যারা দিয়ে গেছো প্রাণ, ভুলিনি আমরা/কোনোদিন ভুলবো না সেই অবদান, কোনোদিন ভুলবো না’ গানটি। এরপর গেয়ে শোনান ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যরাগে’ এবং ‘আমায় গেথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’।
 
দেশের গান গাওয়ার আগে তিনি বলেন, ‘এখানে আসতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে। আমি কদিন ধরে একটু অসুস্থ ছিলাম। কিন্তু এখানে আসার প্রস্তাব পেয়ে লোভ সামলাতে পারিনি। কারণ এতো বড় একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে আমাদের বিজয়ের মাসে। এজন্য আমি ডেপুটি-হাইকমিশনার সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই। ’
 
দেশাত্মবোধক তিনটি গানের পর রুনা পরিবেশন করেন ‘ইস্টিশানের রেলগাড়িটা’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’। ১৯৭৪ সালে ‘স্বরলিপি’ ছবির ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে কী হবে’র মাধ্যমে প্রথমবার বাংলা ছবিতে গেয়েছিলেন রুনা। শুনিয়েছেন সেটাও। গেয়েছেন নিজের পছন্দের গান ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে, যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখ ভরে, তুমি এলে’।
 
‘বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে’ গানটির মুখ গাওয়ার পর রুনা নাচার জন্য মঞ্চে ডাকেন তালাশ মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হীরক দাশগুপ্তকে। উৎসবের তৃতীয় দিনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনিই। অনুষ্ঠানে ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’ গানটি গাওয়ার শুরুতে প্যারোডি করে দর্শকদের আনন্দ দিতে রুনা গাইলেন এভাবে- ‘বন্ধু তিন দিন কলকাতা আইলাম, নেতাজীতে আইলাম, তালি শুনলাম না...!’ এই গান পরিবেশনের মাঝে তিনি ডেকে নেন উপ-হাইকমিশনার জকি আহাদকে। তিনি নেচেছেন, গলাও মিলিয়েছেন। এই গানের সময় দিনের প্রথম ভাগে সংগীত পরিবেশন করা বাউল ও লালনগীতির শিল্পীরাও মঞ্চে উঠে আনন্দে মাতেন।
 
শেষ গান পরিবেশনের আগে ঢাকা থেকে যাওয়া যন্ত্রশিল্পীদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন রুনা। বাজিয়েছেন মিলন ভট্টাচার্য (তবলা), ফোয়াদ নাসের বাবু (কি-বোর্ড), রূপতনু (কি-বোর্ড), সাদিক (অক্টোপ্যাড), সেলিম হায়দার (গিটার), তানিম (বেজ) ও মনিরুজ্জামান (বাঁশি, স্যাক্সোফোন)। তাদের মধ্যে মনিরুজ্জামানের বাবা একসময় রুনার কনসার্টে বাজাতেন।
 
‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ গানের মতো ‘সাধের লাউ’ শোনানোরও প্রচুর অনুরোধ এসেছে। বাংলা ভাষার গান হওয়ায় তা শুনিয়ে পরিবেশনা শেষ করেন রুনা। তার আগেই গানটি নিয়ে বলেছেন মজার একটি ঘটনা। ১৯৭৫-৭৬ সালে এই গানের রেকর্ডিং হয়েছিলো কলকাতায়। এরপরই তিনি চলে আসেন ঢাকায়। দু’তিন মাস পরে ফের কলকাতায় যান রুনা। ততোদিনে গানটা বাজারে এসেছে, জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ। বাকিটা তার বয়ানেই পড়ুন, “ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট দিলাম। দায়িত্বরত কর্মকর্তা পাতা উল্টানোর কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আপনি কি সেই সাধের লাউ?’ আমি বললাম যে, না দাদা। আমি গেয়েছি। আমি সাধের লাউ নই!”
 
সত্যি ঘটনাটা শুনে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে হাসির রোল পড়ে গেলো। পুরো পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে শুধু গান শুনিয়ে নয়, মজার মজার কথা বলেও দর্শক-শ্রোতাকে আনন্দে মাতিয়েছেন রুনা। তার কথা হোক কিংবা গান, মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছিলো সবাই। এর চেয়েও বড় কথা, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি সেখানে এসেও নিজেকে বাংলায় ধরে রেখে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। এই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বাররা। বাংলাদেশ বিজয় উৎসবের শুরুতেই গানে গানে রুনা জানিয়েছেন, তাদেরকে কোনোদিন ভুলবেন না!
 
 

** বাংলাদেশ বিজয় উৎসবে বিপুল দর্শক সমাগম
** বাংলাদেশই বাংলা ভাষাটা ধরে বেঁচে আছে
** জমে উঠেছে বাংলাদেশ বিজয় উৎসব
** বিজয় দিবসের কাকভোরে কলকাতার পথে পথে
** নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে এক টুকরো বাংলাদেশ
**কলকাতায় শুরু হলো বাংলাদেশ বিজয় উৎসব
** ‘মমতার অন্তরের একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যদিকে বাংলাদেশ’

কলকাতা সময় : ০০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।