ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো…’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৮
 ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো…’ বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের উত্তম-সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয়তায় আজও ভাটা পড়েনি। ছবি-সংগৃহীত

যাঁর আত্মপ্রকাশ এক্সট্রার ভূমিকায়, যাঁর প্রথম ছবিটি আজও মুক্তি পায়নি, যাঁর প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে মোটেও সফল হয়নি, তিনিই পরিণত বয়সে বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক। উত্তম কুমার।

অভিনয়ে, গ্ল্যামারে, সিনেমার গানের লিপসিংয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী উত্তম কুমার কেবলই জোর দিয়েছিলেন অভিনয়ে।

যদিও রূপালি পর্দায় গানে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন।

এমনকি, উত্তম কুমার একাধিক ছবিতে সুর দিলেও নিজের গান স্বকণ্ঠে স্থান দেননি সিনেমায়। অথচ সমসাময়িক প্রায়-প্রতিটি গায়কের গান ধারণ করেছেন নিজের কণ্ঠে। নিজের সুকণ্ঠকে পর্দায় ব্যবহার না করে বিভিন্ন শিল্পীর গানকেই যুৎসইভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজস্ব অভিনয়শৈলীতে।  গান গাইবার তৈরি গলা ছিল তাঁর। ছিল দীর্ঘকালীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। ঘরোয়া আসরে যে মানের গান তিনি গাইতেন, তাতে ছবিতে গান গাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় বা প্রযোজনার ছবিতে নিজে গান গাওয়ার চেষ্টা তিনি করেননি। পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গিতে সঙ্গীতশিল্পীর গানই নিয়েছেন।

মনে হয়, গোপন প্রেমের মতো নিজের গলার গানকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন উত্তম কুমার।  অথচ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্রর গান পর্দায় এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে, মনে হয় তিনিই গাইছেন। শিল্পী বদলের কারণে যে কণ্ঠের পার্থক্য হয়েছে, সেটা দর্শক টেরই পায়নি। মনে করেছে, সবই উত্তমের গাওয়া।

বিচিত্র ধরনের গান, বিভিন্ন পটভূমিতে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন উত্তম কুমার।  ‘শাপমোচন’ ছবির পথ চেয়ে বসে থাকা নায়কের গলা থেকে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র পত্নীভক্ত স্বামীর কণ্ঠে চলে যেতে তাঁর মতো পারঙ্গমতা কেউ দেখাতে পারবেন না।

‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে তিনি বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে দশটি গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন।  কিন্তু কোথাও কোনও ছন্দপতন বা পার্থক্য মনে হয়নি। অভিনয়কে জাত শিল্পীর মতোই ঘটনার আবহের সঙ্গে এমন সুন্দর করে মিশিয়ে দিতেন যে, গানে শিল্পীর কণ্ঠের তারতম্য বোঝাই যেতো না।

আধুনিক মেলোডি গানের অনেকগুলোই এসেছে কলকাতার সিনেমা থেকে, উত্তমের ঠোঁটে। ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫) ছবির গানগুলো শুনলে পর্দার গায়ক উত্তম কুমার আর বাস্তবের গায়ক হেমন্তকে আলাদা করা যায় না। অর্ধশত বছর পেরিয়েও গানগুলো সমান জনপ্রিয়। যেমন, ‘বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনেরই গান গেয়ে’, ‘শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হলো সাথী’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’।

‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্ট নীড়’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’ ইত্যাদি ছবিতে অসাধারণ সব গান উত্তম কুমারের ঠোঁটে জীবন্ত হয়ে আছে। অনেক গান, হয়ত গান হিসাবে ভালো, এতোটা জনপ্রিয় ও পরিচিত হতো না, যদি উত্তমের ঠোঁটে পর্দায় স্থান না পেতো!

উত্তম কুমারের প্রায়-সব ছবিই বাঙালি দর্শকের দেখা। আজকাল তো ইউটিউব সার্চ করলেই মোবাইল ফোনের পর্দায় ছবিগুলো দেখে নেওয়া যায়। আগে অত সহজ ছিল না। ভিসিআরের টেপে ছবিগুলো দেখতে হয়েছে। বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ির কাছে ‘রোজভ্যালি’ নামে একটি বড় ভিডিও’র দোকান ছিল। পুরনো স্টেডিয়ামেও তাদের একটি শো-রুম ছিল। আরেকটি ছিল ‘ভিডিও কানেকশন’ নামে। দোকানগুলো এখন উঠে গেছে।

লুপ্ত দোকানগুলো নিয়ে উত্তম কুমার সংক্রান্ত একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। ‘রোজভ্যালি’কে বলে উত্তমের সব ছবির ক্যাসেট আনিয়ে দেখেছিলাম। মাস্টার কপি থেকে কিছু কপিও করেছিলাম। যদিও এখন আর দেখার দরকার হয় না, তবু কিভাবে যেন ক্যাসেটগুলো রয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে ক্যাসেগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, সিনেমায় ঠোঁট মেলানো উত্তমের কোন গানটিকে আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়?’ 

আমার উত্তর তৈরিই থাকে। কালবিলম্ব না করে আমি ‘হারানো সুর’ ছবির সেই গানটিকেই বেছে নিই: ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে…। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।