ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

‘জীবনের ঝুঁকি দেখে ডামিম্যান পালায়, পরে শটটি আমি দেই’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৯
‘জীবনের ঝুঁকি দেখে ডামিম্যান পালায়, পরে শটটি আমি দেই’ আতিকুর রহমান চুন্নু। ছবি: রাজীন চৌধুরী/বাংলানিউজ

পরিবারের ইচ্ছে ছিল পুলিশের লোক হবেন তিনি, কিন্তু শৈশব থেকেই তার প্রবল আগ্রহ সিনেমার প্রতি। শেষ পর্যন্ত আলো ঝলমলে দুনিয়াতেই পর্দাপণ করেন আতিকুর রহমান চুন্নু। তিনি এখন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের নন্দিত অ্যাকশন পরিচালক। ঢাকাই সিনেমার হাতেগোনা কয়েকজন অ্যাকশন পরিচালকের নাম নিতে গেলে তার নাম ধরতে হয় শীর্ষেই।

হেমন্তের নরম রোদের এক বিকেলে রাজধানীর উত্তরার রাস্তায় সিনেমার শুটিং করছিলেন চুন্নু। সেখানেই বাংলানিউজের কাছে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ঝুলি খুলে বসেন তিনি।

 

‘আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। তিনি চেয়েছিলেন আমিও যেন পুলিশের লোক হই। কিন্তু শৈশব থেকেই বড় পর্দা আমাকে খুব টানতো। তাইতো এখন অ্যাকশন ডিরেক্টর হয়ে গেলাম। ’

রূপালি জগতে চুন্নুর পদার্পণ ১৯৭৭ সালে। চিত্রপরিচালক মোতাহার হোসেনের (প্রয়াত) হাত ধরে শাহজাহান চৌধুরীর ‘পিঞ্জর’ সিনেমাতে প্রথম অভিনয় করে ক্যারিয়ার শুরু করেন চুন্নু। এরপর তার সখ্য হয় চিত্রনায়ক জসিমের (প্রয়াত) সঙ্গে। জায়গা পান জসিমের ফাইটিং দল ‘জেমস গ্রুপ’-এ। তার হাত ধরেই চুন্নু বনে যান অ্যাকশন পরিচালক। এখন পর্যন্ত ৬৭৫টি সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি।

চুন্নু বলেন, ‘শিক্ষাজীবন থেকেই আমি নিয়মিত ব্যায়াম করতাম। জসিম ভাই আমার দেহের গঠন দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ব্যায়াম করানোর জন্য প্রস্তাব দেন। আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর নিয়মিত তার মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়ে তাকে ব্যায়াম করাতাম। তিনি আমাকে সিনেমার শুটিংয়ে নিয়ে গিয়ে অ্যাকশন শেখাতেন। সেখান থেকে ফাইটার হই। এরপর হলাম অ্যাকশন পরিচালক। ’
আতিকুর রহমান চুন্নু।  ছবি: রাজীন চৌধুরী/বাংলানিউজবাংলাদেশের ‘মায়ের দোয়া’, ‘আগুন’, ‘দুই রংবাজ’, ‘ওমর আকবর’, ‘মাস্তান রাজা’, ‘জিদ্দি’, ‘কালিয়া’ ‘লালু মাস্তান’, ‘বাহাদুর’, ‘তুফান মেইল’, ‘গেরিলা’, ‘জয়যাত্রা’সহ অসংখ্য সিনেমার অ্যাকশন পরিচালক তিনি। এছাড়া কলকাতার ‘শিবা’, ‘অন্যদাতা’, ‘অন্যায়’সহ বেশকিছু সিনেমাতেও কাজ করেছেন চুন্নু।

অ্যাকশন পরিচালক হিসেবে চুন্নুর আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজিত সিনেমা ‘অন্যায় অবিচার’র মধ্য দিয়ে। সিনেমাটিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন কলকাতার অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী ও বাংলাদেশের রোজিনা।  

চুন্নুর ভাষ্যে, ‘প্রয়াত ক্যামেরাম্যান কাজী বসির আমাকে একদিন বললেন, তুমি পরিচালনা কর না কেন? ক্যামেরার কাজ ও ফাইট দুইটাই তো ভালো পারো। তারপর তিনিই আমাকে শুটিংয়ের জন্য বোম্বে (বর্তমান ভারতের মুম্বাই) নিয়ে গেলেন। কাজটা করে অনেক আত্মবিশ্বাস পেলাম। এই সিনেমা মুক্তি পেলে একের পর এক নতুন সিনেমার প্রস্তাব আসতে থাকে। ’

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহুবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে শুটিং করেছেন চুন্নু। আহতও হয়েছেন অনেক। তবু শুধু কাজকে ভালোবেসে বারবার ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্ট দিয়েছেন তিনি।  

‘দস্যু ফুলন’ সিনেমার শুটিংয়ে কাচপুর সেতু থেকে লাফিয়ে পড়ার একটি দৃশ্যের বর্ণনা শোনা যাক তার মুখেই, ‘সিনেমাটির অ্যাকশন পরিচালক ছিলাম আমি। দৃশ্যটি ছিল আত্মহত্যা করার জন্য সেতুর ওপর থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়বেন অঞ্জু ঘোষ। তার ডামি দেওয়ার জন্য একজন প্রফেশনাল ডামিম্যানকে ডাকা হয়। শুরুতে দৃশ্যটি আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়, তাই আমি জসিম ভাইকেও শুটিংয়ে ডাকি। ক্যামেরা নিয়ে আমরা সেতুর নিচে প্রস্তুত, অঞ্জুর মতো পোশাক পরে ডামিম্যান সেতুর কিনারে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু তিনবার শটটি এনজি (নট গ্রান্টেড) হয়। ডামিম্যান বারবার লাফ দিতে গিয়ে হাত দিয়ে শট কেটে দিতে বলছেন। এক পর্যায় দেখি ডামিম্যানকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর জানলাম জীবনের ঝুঁকি দেখে ডামিম্যান নারীদের পোশাক পরেই বাসে করে সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন। এরপর আর কোনো দিন তিনি সিনেমায় কাজ করেননি। ’ 
আতিকুর রহমান চুন্নু।  ছবি: রাজীন চৌধুরী/বাংলানিউজ‘পুরো শুটিং ইউনিটের মন খারাপ হয়ে যায়। শুটিং যদি না হয় তাহলে অনেক টাকা লোকসান হবে। এরপর সাহস করে আমিই পোশাক পরে শটটি দেই। পানিতে লাফ দিয়ে প্রায় ১৫ ফুট নিচে চলে যাই। ভেবেছিলাম বাঁচবো না। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সে যাত্রায় রক্ষা পাই। অনেক ভয় কাজ করছিল, কিন্তু তবু আমার ওস্তাদ জসিম ভাই শুটিংয়ে এসেছেন এবং দায়িত্বের কথা চিন্তা করে ঝুঁকিটা আমি নিয়েছিলাম। এরপর প্রযোজক খুশি হয়ে যেখানে দুই হাজার টাকা দেওয়ার কথা, সেখানে আমাকে দিলেন ১০ হাজার টাকা। ’

বাজেট স্বল্পতা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের সুবিধা না থাকা ও প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র সরবরাহের অভাবে আমাদের দেশে এখনো উন্নতমানের অ্যাকশন সিনেমা করা সম্ভব হচ্ছে না বলেন মনে করেন চুন্নু। তিনি বলেন, ‘অ্যাকশনের দিক থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। টাম্বলিং বোড, এয়ার বোড, স্প্রিং, সুগার গ্লাসসহ অনেক উন্নতমানের জিনিস আমরা ব্যবহারের জন্য পাই না। শুটিংয়ে অরিজিনাল গ্লাসে হীরা দিয়ে দাগ কেটে আমাদের জাম্প দিতে হয়। এতে করে আমাদের হাত-পা কেটে যায়। ভারতের অ্যাকশন সিনেমার সঙ্গে তুলনা করলেও আমরা এখনো বহু বছর পিছিয়ে আছি। ’
 
ইন্ডাস্ট্রির মানুষের কাছে তিনি চুন্নু মামা বলেই পরিচিত। তিতুমীর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে পলিটেকনিক থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেছেন তিনি। বেশ কিছুদিন রাজউকেও চাকরি করেছেন চুন্নু। সিনেমায় কাজ করতে পেরে নিজেকে তৃপ্ত বলেই জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৯
জেআইএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।