ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

নন্দিত-নিন্দিত তাপস পাল

বিনোদন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
নন্দিত-নিন্দিত তাপস পাল

বাঙালির প্রিয় অভিনেতা তাপস পাল চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে খুবই দুর্বিষহ। সিনেমায় কাজ পাওয়ার আকুতি, কাগজে মুখ ঢেকে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করা, বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি, দুর্নীতি মামলায় জেল খাটা, সবার কাছে ক্ষমা চাওয়া, সব মিলিয়ে মর্মান্তিক ছিল তার বিদায়।

শেষ বয়সে যেমন শরীর ভালো ছিল না, তেমনই মানসিক শান্তিও ছিল না তাপস পালের। এমনকি, শেষের দিকে আবার অভিনয়ে ফিরতে চেয়ে কাজ খুঁজছিলেন তিনি।

জানিয়েছেন পরিচালক অরিন্দম শীল ও অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদার।

অরিন্দম শীল তাপসের মৃ্ত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন, খুব বড় অভিনেতা ছিলেন তাপস। উত্তম কুমারের পরে তারকা হিসেবে তাকে ধরা যায়। কিন্তু মাস দুয়েক আগে কাজের খোঁজ করে ফোন করেছিলেন তাপস। আমি অবাক হয়েছিলাম যে তাপস পালের মতো অভিনেতা আমায় ফোন করে কাজ চাইছেন!

অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদারকেও কাজের খোঁজ করতে বলেছিলেন তাপস পাল। এই অভিনেত্রী বলেন, তাপসদার মতো অভিনেতার চলে যাওয়া বড় ক্ষতি। তিনি একজন ভালো মানুষও ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন আবার কাজে ফিরতে চাই। কোনও প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে দেখিস কোনও কাজ আছে কি না। আমি বলেছিলাম, আরে তুমি তাপস পাল। তোমার মতো অভিনেতা দরকার। নন্দিনীদিও (তাপস পালের স্ত্রী) ফোন করে বলেছিলেন, দেখ তোর দাদাকে একটু ব্যস্ত করা যায় কি না।

তাপস পাল

অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক বলেন, প্রায় ৩০ বছর একসঙ্গে আমরা কাজ করেছি। তার মৃত্যু খুবই দুঃখের এবং যন্ত্রণার। আসলে কপালে থাকলে যা হয়। খুব দুর্ভাগ্যজনক। খুব ভালো অভিনেতা ছিল। এরকম হঠাৎ চলে যাবে ভাবিনি। কিছুদিন আগের একটি ছবি দেখেছিলাম, সেখানেও ক্লান্তির ছাপ ছিল। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল শরীর দিচ্ছে না।

একসময় নায়ক হয়েও খবরের কাগজ দিয়ে মুখ লুকাতে হতো তাপস পালকে। কারণ তার হাতে ছিল না পয়সা। আবার রাজনীতির মাঠে ‘খলনায়ক’ হয়ে যাওয়ার পর অনুশোচনায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে মরতেন সব সময়। ছোট একটি ভুলের জন্য চন্দননগরের সকল বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন অভিনেতা থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা তাপস পাল। তার ছোটবেলার বন্ধু থেকে পরিচিতদের কথায় উঠে এসেছে এরকম অনেক চাঞ্চল্যকর কথা।

তাপস পালের এক বাল্যবন্ধু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান নায়ক তাপস পালের প্রথম অভিনয় জীবনের সংগ্রাম ও অর্থাভাবের কথা। জানা যায়, ‘দাদার কীর্তি’ সিনেমাটি তাপস পালকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে কোনও টাকা পাননি তাপস। আর সেই কারণেই পরের ছবির শুটিংয়ের সময় চন্দননগরের বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতেন। ভোর সাড়ে ৩টায় চন্দননগর স্টেশন থেকে লোকাল ধরে কলকাতায় চলে যেতেন। আর রাতের লাস্ট ট্রেনে চন্দননগরে ফিরতেন। হাতে থাকত একটা খবরের কাগজ। কারণ লোকের মুখে মুখে ফিরত ‘দাদার কীর্তি’র নায়ক তাপস পালের কথা। তাই কেউ যাতে চিনতে না পারেন, সেজন্য কাগজ দিয়ে মুখ ঢেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতেন তিনি।

বন্ধুরা জানান, নারদা-সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ, জেলজীবন সবকিছু নিয়ে সবসময় কুঁকড়ে থাকতেন তাপস পাল। কেউ ফোন করলেই, তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করতেন। গত বছরই ডেকে পাঠিয়েছিলেন কয়েকজন বন্ধুকে। নিজের কিছু ভুল মন্তব্যের জন্য বন্ধুদের কাছে বার বার তখন ক্ষমা চান তিনি। শেষজীবনে অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতেন ‘গুরুদক্ষিণা’খ্যাত অভিনেতা।

সিবিআইয়ের জিম্মায় দীর্ঘ হাজতবাস করেন তাপস পাল

তাপস পালের মৃত্যুতে তার বন্ধু ও সহকর্মী চিরঞ্জিত চক্রবর্তী ও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় হয়ে পড়েন শোকস্তব্ধ। এক সাক্ষাৎকারে চিরঞ্জিত বলেন, আবার একটা উজ্জ্বল, ঝকঝকে তাপস পালকে দেখব ভেবেছিলাম, কিন্তু তা আর হলো না।  

টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, বাংলা ছবি যে সময়টায় একজন দক্ষ অভিনেতার অভাব অনুভব করছিল, ঠিক সেই সময়েই তাপসের ‘গুরুদক্ষিণা’ মুক্তি পেল। আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। বাংলা সিনেমা আজ এক নক্ষত্রকে হারালো। আর আমি একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারালাম।

‘অবোধ’ সিনেমায় তাপস পাল ও মাধুরী দীক্ষিত

তাপসের বিপরীতে ‘অবোধ’ সিনেমার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বলিউডের গ্ল্যামার কুইন মাধুরী দীক্ষিত। তাই নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম নায়কের মৃত্যুতে তিনি লেখেন, ‘তাপস পাল প্রয়াত হলেন। আমার অভিনয় জীবনের প্রথম যুগের বিভিন্ন অভিনেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রার্থনা করি, এই কঠিন সময়ে ঈশ্বর তার পরিবারের সহায় হবেন। ’

অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতেও জায়গা করেছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দু’বারের বিধায়ক এবং দু’বারের সাংসদ তিনি। আর কোনও বাঙালি অভিনেতা এতটা সাফল্য এখনও দেখাতে পারেননি নির্বাচনী রাজনীতিতে। কিন্তু তারপর ক্রমেই ট্র্যাজেডি ঘিরে ধরে তাকে।

শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত তাপস পাল

একের পর এক বিতর্কে ক্রমশ ‘খলনায়ক’ হয়ে উঠছিলেন তাপস পাল। প্রচণ্ড মানসিক পীড়াতেই হোক বা শারীরিক কারণে, শেষ দিকটায় অসুস্থ ছিলেন খুবই। দীর্ঘ বন্দিদশা থেকেই সম্ভবত তার মানসিক ও শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। স্নায়ুর সমস্যা বেড়েছিল বন্দি থাকাকালীন। জামিন পাওয়ার পরে ঈশ্বরের নাম নিয়ে তাপস পালের আকুল কান্নার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল গোটা বাংলায়।

রাজনৈতিক সভায় ‘ধর্ষণের হুমকি’ দিয়ে অপযশ কিংবা রোজ়ভ্যালি-কাণ্ডে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআইয়ের জিম্মায় দীর্ঘ হাজতবাস নানা বিতর্কে জড়িয়েছিলেন সাংসদ তাপস পাল। বেশ কয়েক বছর ধরে স্নায়ুর জটিল সমস্যা, সুগার, হার্টের গোলমালেও ভুগছিলেন তিনি। মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে সবার অলক্ষ্যে এক বুক কষ্ট নিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান উত্তমকুমার-পরবর্তী যুগের নন্দিত নায়ক তাপস পাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।