ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান রাজশাহী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২২ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২০
এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান রাজশাহী

রাজশাহী: দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। শেষ হলো তার জীবনের গল্প, পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন তিনি। 

সোমবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি। বলা হয়, যার খ্যাতির চাইতে কণ্ঠের দ্যুতিই ছিলো বেশি।

সুরের যাদুকর ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তার মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো। যা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহী শহরের শ্রীরামপুর মিশন হাসপাতাল এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ ও মা মিনু বাড়ৈ। রাজশাহীতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।  

ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সঙ্গীতের দীক্ষায় দীক্ষিত হন। রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে রবীন্দ্র-নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। পরে গানের নেশায় ছুটে যান রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু মাটির মায়ায় জড়িয়ে থাকেন রাজশাহীর সঙ্গেই। রাজশাহীর সংগীতাঙ্গনে তার বিচরণ ছিল সর্বদা। কখন বিচ্যুত হননি।

>>>চলে গেলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর

দরাজ কণ্ঠের এই শিল্পীর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে,  ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে হৃদয় যেখানে’ প্রভৃতি।

এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক যাত্রা শুরু ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদান রাখার জন্য তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

টানা ৯ মাস ধরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থেকে গত ১১ জুন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর ২০ জুন থেকে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এই শিল্পী। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তার প্রস্থানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন রাজশাহীর শিল্প-সংস্কৃতি অনুরাগীরা।  

>>>রামেক হাসপাতালের হিমঘরে এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ

এই সুর স্রষ্টার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। এছাড়াও রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

বিশিষ্ট নাট্যকার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর মলয় ভৌমিক বলেন, এন্ড্রু কিশোর আমার বন্ধু ছিলেন। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে আমরা একসঙ্গে ১৯৭৮ সালে মাস্টার্স পাস করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থেকে আমরা একইসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে যেতাম। সে কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেলে আমি সেখানে উপস্থাপনা করতাম। আমাদের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। অনেক সময় কোনো অনুষ্ঠানে গেলে উপস্থাপনা কে করছে সে জানতে চাইতেন। তখন উপস্থাপনার জন্য তিনি আমার নাম বলতেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পৃথিবীতে যারা এসেছে সবাই একদিন চলে যাবে। এই সত্যটা আমাদের মানতে হয়। কিন্তু এই একজন মানুষ, যে চলে গেল সত্যিকার অর্থেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। কারণ আমাদের দেশের গণমানুষের জন্য সঙ্গীতের যে চর্চাটা ছিল সেটা তার হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল। তার যা কণ্ঠ, তার যে ত্যাগ-তিতীক্ষা, সংগীতের সেটি কারো সঙ্গে তুলনা চলে না আমি মনে করি। তাই তার বিদায়ে আমাদের অতুলনীয় ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, এন্ড্রু কিশোর সংগীতের মধ্য দিয়ে লাখো-কোটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। তার মৃত্যুতে জাতি একজন মেধাবী সঙ্গীত ব্যক্তিত্বকে হারাল। এ শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

রাজশাহী থিয়েটারের সভাপতি কামারুল্লাহ সরকার বলেন, বছর তিনেক ধরে রাজশাহীতে এন্ড্রু কিশোর নিয়মিত সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন এবং মাসে একটি করে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতেন। এটা সবাইকে একত্রিত করার চমৎকার একটা উদ্যোগ ছিল। এই উদ্যোগটা আরও আগে হলে হয়ত রাজশাহীর মানুষ আরও বেশি উপকৃত হতো।

রাজশাহীর নিক্বণ নৃত্যশিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক হাসিব পান্না বলেন, কিশোরদার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তিনি আমার অনেক সিনিয়র। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮০ সালে রাজশাহী মোটেল যখন উদ্বোধন হয় সে অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন কিশোরদা। তখন সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা ছিলো। মজার ব্যাপার হলো কিশোরদা জানালেন যে নাচের ব্যবস্থা করতে হবে। এতো বড় অনুষ্ঠান। আমার বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ ছিলো। কিশোরদাকে বলেছিলোম গাড়ি নিয়ে বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর আমি বাড়ির দেয়াল টপকে বের হয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে তখন সরকারের একজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমার পারফর্মমেন্স দেখে পুরস্কার ঘোষণা করেন।

সঙ্গীতশিল্পী আলমগীর হোসেন বলেন, তার মৃত্যু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে হতাশ করেছে। রাজশাহীর যারা সারা বাংলাদেশে সংগীতে নেতৃত্ব দিতো সেই এন্ড্রু কিশোর, এম এ খালিদ, রিজিয়া পারভিন, রফিকুল আলমের মতো শিল্পী হয়তো আর আসবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০২১৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০২০
এসএস/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।