জহির রায়হান নামে বাংলাদেশের যে কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার-ঔপন্যাসিক-গল্পকারকে আমরা চিনি তার সত্যিকারের নাম কি আসলেই তাই? না, ঠিক তা নয়। তার আসল নাম আবু আবদাল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ এবং ডাকনাম জাফর!
১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্ম নেন তিনি।
তার পিতার নাম মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ যিনি কলকাতার এক আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। এজন্য তারা পরিবারসহ কলকাতায় থাকতেন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর তারা সপরিবারে ফিরে আসেন ঢাকায়। ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন জহির রায়হান এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি, এরপর বাংলা সাহিত্যে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।
বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রভাবে তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তিনি পার্টির হয়ে চিঠি আদান-প্রদানের দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে তার নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। জহির রায়হানকে ছাত্র জীবনে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জেল খেটেছেন তিনি, ভাষার দাবিতে ঢাকা শহরে মিছিলে নেমে গ্রেফতার হন তিনি।
১৯৫০ সালে যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন জহির রায়হান। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন প্রবাহ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ। তার লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম শেষ বিকেলের মেয়ে যা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তার লেখা অন্যান্য বইগুলি হচ্ছে ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ এবং ‘আর কত দিন’।
মাত্র দুই দশকের সাহিত্যচর্চায় ৭টি উপন্যাস, ২টি গল্পগ্রন্থ রচনা করেন তিনি। হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন জহির রায়হান। নবম-দশম শ্রেণিতে এই উপন্যাসটি অনেক শিক্ষার্থীরই পাঠ্য বিষয় ছিল।
সিনেমা জগতে তার প্রথম পদার্পণ ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নামের এক উর্দু সিনেমাতে সহকারী পরিচালক হিসেবে। ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১) সিনেমার মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ পরিচালনায় আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার নির্মিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭), এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে যুদ্ধকালীন পাকিস্থানের বর্বরতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন তিনি। এছাড়াও ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তার একটি স্বপ্নের এবং অসমাপ্ত চলচ্চিত্র। তার নির্মিত উর্দু সিনেমা সঙ্গম ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা, অপর উর্দু সিনেমা বাহানা পাকিস্থানের প্রথম সিনেমাস্কোপ সিনেমা।
১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে (মরণোত্তর) একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন। এছাড়াও চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কারে সন্মানিত করা হয়।
জহির রায়হান ব্যক্তিজীবনে দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং দুজনেই ছিলেন তখনকার সময়ের স্বনামধন্য চিত্রনায়িকা। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন চিত্রনায়িকা সুমিতা দেবী যার সঙ্গে ১৯৬১ সালে বিয়ে হয়। প্রথম পরিবারে জন্ম নেয় অনল রায়হান এবং বিপুল রায়হান নামে দুই পুত্র সন্তান। সুমিতা দেবীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৯৬৮ সালে আরেক জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা সুচন্দার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি। দ্বিতীয় পরিবারে রয়েছেন তার দুই সন্তান অপু রায়হান ও তপু রায়হান। তার বড় ভাই প্রয়াত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের মাসে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে তার প্রাণের প্রিয় বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। কথিত আছে মিরপুরে বিহারী অঞ্চলে ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে তিনি পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে দেশ চিরদিনের জন্য হারায় এক মহান কিংবদন্তিকে...
অখণ্ড পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ, প্রথম রঙিন ছবি, বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের নির্মাতা-এতসব কীর্তি আছে যার ঝুলিতে, তার সিনেমার নামের মতো করেই বলতে হয়, এরপর আর ‘কখনো আসেনি’ জহির রায়হানের মতো নির্মাতা।
*লেখক ও চলচ্চিত্র গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২১
জেআইএম