ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

প্রাণী বৈচিত্র্যের ‘সুপার হট স্পট’ চবি অরক্ষিত

সাজিদুল হক সাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১২
প্রাণী বৈচিত্র্যের ‘সুপার হট স্পট’ চবি অরক্ষিত

চবি থেকে ফিরে : অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে জীব-বৈচিত্র্যের ‘সুপার হট স্পট’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারোরই যেন মাথাব্যথা নেই বৈচিত্র্যের এই বিশাল ভাণ্ডার সংরক্ষণে।

সংশ্লিষ্টদের হাত গুটিয়ে বসে থাকার ক্ষমাহীন নিষ্ক্রিয়তায় হারিয়ে যেতে বসেছে নানা প্রজাতির অসংখ্য প্রাণী।

এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- এর পেছনের কারণ হচ্ছে অর্থ ও জনবলের সমস্যা। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উদ্যোগহীনতাকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের সমন্বয়ে পরিবেশ পরিষদ গঠন করে চবির সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের দাবিও করছেন অনেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীর আবাসস্থল পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাই চবি হতে পারে প্রাণী গবেষকদের জন্য তীর্থস্থান।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চবিতে রয়েছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখি। স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ১৬ প্রজাতির। দেশে আবিষ্কৃত ৩৫ প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে ২৫ প্রজাতিরই দেখা মেলে চবিতে। তবে সরিসৃপের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব-বৈচিত্র্যের বিষয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী সৈয়দ আসমত বাংলানিউজকে বলেন, ``ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট (ডব্লিউআরআই) ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভারসিটি হট স্পট’কে জীব জগতের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে একটি আকর স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছে। ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও বাংলাদেশের সিলেটের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত এ হটস্পট বিস্তৃত। ``

তিনি বলেন, ``এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে এ জোনের মধ্যে সবচেয়ে সুপার হটস্পট হিসেবে আমরা মনে করি। কারণ হটস্পটের বিশাল এলাকার মধ্যে তুলনামূলক ছোট্ট এ জায়গায় যে পরিমাণ প্রাণী-প্রজাতি বসবাস করে তা অবিশ্বাস্য। ``

চবির কাটাপাহাড় অঞ্চলকে ব্যাঙের জন্য ‘সুপার সুপার হট স্পট’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ``আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি রাস্তায় যে পরিমাণ ব্যাঙের প্রজাতি রয়েছে তা সত্যিই অবাক করার মতো। এ অঞ্চলটি সংরক্ষণ করা সবচেয়ে জরুরি। ``

চবির বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে-সাদামাটা নাকুটি, তিন প্রজাতির সুঁইচোরা, একাধিক প্রজাতির ঘুঘু, কয়েক প্রজাতির মাছরাঙা, ময়না, টিয়া, মুনিয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অন্যান্য পরিচিত পাখিগুলোও পর্যাপ্ত সংখ্যায় দেখা যায়।

তবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বনরুই, লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, পিগটেল বানর (শুয়োর লেজী বানর)সহ বেশ কিছু প্রাণী এখন আর দেখা যায় না।

ব্যাঙ এর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাপ্তিস্থান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে বাংলাদেশে প্রথম আবিষ্কৃত ফ্যাজারভেরিয়া আসমতি (বাংলাদেশি ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ), সুন্দরী ব্যাঙ, চীনা ব্যাঙ, তাইপে ব্যাঙ (২০০৬ সালে তাইওয়ানে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। পরে চবিতে এর সন্ধান পাওয়া যায়), ২ প্রজাতির গেছো ব্যাঙ প্রভৃতি। এছাড়া আরো এক প্রজাতির গেছো ব্যাঙ পাওয়া গেছে যেটা এখনও জরিপের আওতায় আসেনি।

চিতাবাঘ একসময় এ এলাকায় দেখা গেলেও এখন আর পাওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আদিবাসীদের হাতে নির্বিচার নিধনের ফলে বুনো শূকরও এখন আগের মতো দেখা যায়না। কমে যাচ্ছে মায়া হরিণেরও সংখ্যা। রেসাস বানরও ক্রমশ কমছে চবিতে।
 
২০০৩ সালে এখানে সাক্লোমিস ডেনটাটা নামের বিরল প্রজাতির একটি কাছিমও পাওয়া গিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসের পাহাড়-বনানীতে চরে বেড়ানো মায়া হরিণ শিকার করে মাংস বিক্রি করার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ায় হরিণ শিকার কিছুটা কমেছে।

চবির এ বিশাল জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে কি ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে অধ্যাপক আসমত বলেন, ‘কোনো ধরনেরই উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ’

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাজেট হয় তার একটি অংশ প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ করা যায় বলে মত দেন তিনি।

কিভাবে এ অঞ্চল সংরক্ষণ করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ``প্রথমেই চবিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। প্রাণীদের জন্য তাদের মতো করে আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে। তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চবির এ বৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে তাহলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল আসবে। ``

এদিকে, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাজিদ আলী হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, ``চবির এ সমৃদ্ধ জীব-বৈচিত্র্য শুধু একটি বিভাগের জন্য নয়। এটি দেশের সম্পদ। সকল বিভাগের সমন্বয়ে পরিবেশ পরিষদ গঠন করে এ সম্পদ রক্ষা করা যায়। ``

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চবির এক শিক্ষক বলেন, ``চবিতে প্রশাসন শুধুমাত্র কিছু সচেতনতামূলক সাইন বোর্ড লাগিয়ে দায় সেরেছে। এর বেশি কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ``

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাণি-বৈচিত্র্য ও এর সংরক্ষণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. কামরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, ``বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তবেই প্রাণি-বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ালে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ``

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১২

এসএইচ/ সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com;

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

Jewel_mazhar@yahoo.com
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।