ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

মাংস-মধুতে প্রশাসন ম্যানেজ: হাজারো বণ্যপ্রাণী পাচারের ফাঁদে

জাহাঙ্গীর সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১২
মাংস-মধুতে প্রশাসন ম্যানেজ: হাজারো বণ্যপ্রাণী পাচারের ফাঁদে

সাতক্ষীরা থেকে ফিরে: সাতক্ষীরা সংলগ্ন সুন্দরবনের ৯২ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন বন্যপ্রাণী ধরার অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বন্যপ্রাণী বিচরণের অবাধ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় এখন নানা ধরনের ফাঁদ পেতে নিত্যদিনই নির্বিচারে হরিণ, তক্ষক, বাঘশাবক, বিরল প্রজাতির কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ধরছে প্রাচারকারী চক্র।

এরপর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে নিরাপদ রুট বানিয়ে সেগুলো পাচার করা হচ্ছে থাইল্যান্ড আর ইউরোপে।

সম্প্রতি রাজধানীতে কয়েকটি বাঘশাবক আটকের ঘটনার সূত্র ধরে সাতক্ষীরা এলাকায় সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে বেপরোয়া এ চক্রের তৎপরতার কথা জানা গেছে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জলদস্যু ও বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সাতক্ষীরার সাত্তার মোড়ল নামে এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এই পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে কলকাঠি নাড়ছেন।

সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার বন্দোকাঠি গ্রামে চিংড়ি ঘের ব্যবসার আড়ালে বন্যপ্রাণী ধরার চক্র গড়ে তুলেছেন এই ছাত্তার মোড়ল।

প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে শিকার করা হরিণের মাংস আর মধু সংগ্রহ করে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠানোর কারণে প্রশাসনের অনেকেই সাত্তার মোড়লের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন।

গত ১১ জুন রাজধানীর শ্যামলীর এক বাসায় পশুপাখির ক্রেতা সেজে অভিযান চালিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের তিন মাস বয়সী যে তিনটি শাবক র‌্যাব উদ্ধার করে সেগুলোও ছাত্তার মোড়লের লোকদের সংগ্রহ করা ছিলো বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাঘশাবক আটকের সময় সেগুলো পাচারের অভিযোগে ওই বাসার জাহানারা বেগম (৪৭) ও তার ছেলে জাকির হোসেনকে (২০) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের প্রত্যেককে দুই বছর করে বিনাশ্রম কারাদ- দেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা।

কিন্তু র‌্যাবের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে আগেই পালিয়ে যান বাঘশাবক পাচারের অন্যতম হোতা  কাদের।

সে সময় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ওই পরিবারের সদস্যরা স্বীকার করেন,  দীর্ঘদিন ধরে সাতক্ষীরার সুন্দরবন এলাকা থেকে বণ্যপ্রাণী সংগ্রহ করে বিদেশে  পাচার করে আসছেন তারা। বছর দশেক আগেও একবার বাঘের বাচ্চাসহ ধরা পড়েছিলেন পাচারকারী দলের অন্যতম হোতা কাদের।

এদিকে আটকের ১৭ দিন পর বাঘ শাবক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৮ জুন সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ইছা মোড়ল (৩২) নামে এক জনকে গ্রেফতার করে সাতক্ষীরার ডিবি পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া ইছা মোড়ল ডিবি পুলিশের কাছে বাঘশাবক পাচারের সিন্ডিকেট সম্পর্কে  চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন।

তার দেওয়া তথ্যে সেই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা সাত্তার মোড়লের নাম জানতে পারে সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে সময় সাত্তার মোড়লকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি তারা।

এছাড়া বনবিভাগের অপর এক মামলায় মোখলেছুর রহমান (৩৮) নামে আরেক পাচারকারীকে গ্রেফতার করে শ্যামনগর থানা পুলিশ।

সে সময় পুলিশ জানায়, বাঘ পাচারের ঘটনায়  জড়িত  সুন্দরবনের বনদস্যু নুরুজ্জামান গাজী ও জহুর আলীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের নামকরা জলদস্যু রমজান বাহিনীর সঙ্গেও রয়েছে সাত্তার মোড়লের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কিছু দিন পরপর সাত্তার মোড়ল  নিজের ট্রলার নিয়ে সুন্দরবনে ভ্রমণের নামে হরিণ শিকারে যান।   বাঘ শাবক আটকের ঘটনার পর নিজেকে বাঁচাতে সুন্দরবনের গভীরে  ভ্রমণের নামে বেশ কিছু দিন আত্মগোপনেও থাকেন তিনি।

সে সময় সাতক্ষীরার গোয়েন্দা পুলিশ সাত্তার মোড়লের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আফজালকে গ্রেফতার করে।
 
তবে পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে সাত্তার মোড়ল বাংলানিউজকে বলেন, “অনেক দিন ধরে সুন্দরবনে শুধু বাঘশাবক নয়, বিরল প্রজাতির হরিণ, তক্ষক আর কচ্ছপ পাচার হচ্ছে বলে জানি। তবে এসবের সঙ্গে আমার কোনো্প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই। ”

তিনি বলেন, “টাকা পয়সার দিক থেকে এলাকায় আমি প্রভাবশালী। আর এ কারণে এ এলাকায় যা-ই ঘটুক আমাকে তার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়। ”

এদিকে গত ১৬ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যাংকক এয়ারলাইন্সের ব্যাংককগামী একটি বিমানে নেওয়ার সময় আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ৪০৬টি কচ্ছপ ছানাসহ জুলফিকারর আলী হাসনাইন (৪৫) ও অভিজিৎ দাস (৪২) নামে দুই ভারতীয় নাগরিককে আটক করে।

এরপর ৬ আগস্ট গভীর রাতে ব্যাংকক এয়ারলাইন্সের ব্যাংককগামী অপর এক বিমানে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়ার সময় ১০৮টি কচ্ছপ ছানাসহ শেখ কিবরিয়া (৪৮) নামে অপর এক ভারতীয় নাগরিক ও খায়রুল আলম (৩২) নামে এক বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করেন আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এএসপি মিনহাজ ও তার দল।

এ দুই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করে পুলিশ।

আটককৃতরা জিঞ্জাসাবাদে পুলিশকে জানায়, বিদেশে পাচারের জন্য আফসানা (৪০) নামে এক নারী তাদের কচ্ছপ ছানাগুলো দিয়েছিলো।

আফসানা নামে ওই নারীর বাড়ী সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা থানায় বলে জানায় অপর এক সূত্র।
 
এদিকে বাঘ শাবক আটকের পর সে সময় (জুন মাসে) বন বিভাগের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। সে কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কৈখালী স্টেশনের স্টেশন অফিসার আলাউদ্দিন, ফরেস্টার সোহরাব হোসেন, ৩ জন বনপ্রহরী ও ৩ জন নৌকাচালকসহ ৮ জনকে  বাঘশাবক পাচারকারীদের সহযোগিতার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী বাংলানিউজকে জানান, বন্যপ্রাণী পাচার রোধে বনবিভাগের সবাই কে সজাগ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ”

কারও বিরুদ্ধে পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১২
জেএস/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর/ আহমেদ রাজু, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।