ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

যান্ত্রিক নগরের এক টুকরো সবুজ রমনা পার্ক

আয়েশা নুসরাত জাহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৩
যান্ত্রিক নগরের এক টুকরো সবুজ রমনা পার্ক

ঢাকা: শহরটা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। তীব্র যানজট, কালো ধোঁয়া আর ময়লার দুর্গন্ধে আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন।

এমন বাতাসে যেখানে নিশ্বাস নেওয়ার অবস্থা নেই, সেখানে বিশুদ্ধ বাতাস আশা করা যেন বিলাসিতা। বর্ষার দিনে বৃষ্টির দেখা তো মেলেই না বরং উত্তপ্ত রোদে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। চলার পথটা যেন নরকের দিকে চলে গেছে।

মানুষের সীমাহীন ভিড় ঠেলে পথ চলাও সহজ নয়। ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিন ছেড়ে রাস্তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এছাড়া আছে বিভীষিকাময় শব্দ দূষণের যন্ত্রণা। একটু স্বস্তিতে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজে উঠব, সেখানেও বিপত্তি।

অতিরিক্ত গরম আর রোদে উত্তপ্ত ঢাকার সড়ক লোকে লোকারণ্য। শান্তিতে হাঁটা তো দূরে থাক, এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াবারও উপায় নেই। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে গেলেও বিপদ। গাড়ি নয়তো মোটরসাইকেল গায়ের ওপর উঠিয়ে দেবে চালকরা। এমন জাহান্নামকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাকে পেছনে ফেলে যখন রমনার অস্তাচল ফটকের ভেতরে পা রাখলাম পুরো দৃশ্যপট যেন পাল্টে গেল। এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে শরীরটাকে কোনো এক জাদুর বলে সতেজ করে দিয়ে গেল। ঘোড়ার টগবগ শব্দ শুনে সামনে তাকাতেই দেখি সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘোড়ার লাগাম ধরে সাথে সাথে চলছে তার সহিষ। অবচেতন মনের কল্পনা আমায় মনে করিয়ে দিল পঞ্চাশের দশকের কথা। সেই সময় এই রমনা এলাকা ছিল ইউরোপীয় ও ধনীদের ঘুরে বেড়ানোর জায়গা।

হঠাৎই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। পেছনে নেই কোনো লোহার ফটক, নেই ফটকের পাশে দাঁড়ানো হ্যাংলা মতোন দারোয়ানটাও। নিস্তব্ধতা ঘিরে ফেলল যেন আচমকাই। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছিল নাম না জানা কোনো পাখির একটানা চিৎকার। ঘন জঙ্গলের বেষ্টনে যেন আটকে পড়লাম। কল্পনায় দেখছি দু’হাতে ডালপালা সরিয়ে পথ করে সামনে এগোচ্ছি। মনে পড়ল কোম্পানি আমলে রমনা বলতে এমনি এক জঙ্গলকেই সবাই চিনতো।

ঢাকার সেই সময়ের ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস ১৮২৫ সালে রমনাকে কেন্দ্র করে নিসর্গ তৈরির কাজ শুরু করেন। তখন জঙ্গলটি কেটে-ছেটে পরিষ্কার করে নতুন রূপ দেওয়া হয়। তখনও সেটি রমনা পার্ক হয়ে ওঠেনি। ১৯০৮ সালে ঢাকায় এলেন রর্বাট লুইস প্রাউডলক। যাকে রমনা গ্রিনের অন্যতম উদ্যোক্তা বলা হয়ে থাকে। তিনি সে সময় উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের বৃক্ষ ঢাকায় রোপণের ব্যবস্থা করেন।

প্রাউডলকের উদ্যোগেই রমনা আজ দেশি-বিদেশি বৃক্ষের সম্ভারে পূর্ণ। তারপর সেই সময়ের জঙ্গল রমনা পরিণত ও পরিচিত হলো রমনা গ্রিন নামে। রমনা গ্রিনকে রমনা পার্ক হিসেবে তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৫২ সালে। ট্রাক্টরের ঘড়ঘড় শব্দ, মাটি চষে অন্য জায়গায় ফেলার ঝপঝপ শব্দ, সবই যেন আমার কল্পনার ক্যানভাসে একে একে ভাসতে থাকলো। রমনা পার্ককে স্থাপত্য শৈলী ও সবুজের আলিঙ্গনে বাঁধতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন পার্কের একসময়ের পরিচালক প্রয়াত ফজলুল করিম।
 
সামনে এগোতেই আবার সেই চিরচেনা দৃশ্যে ফিরে গেলাম। ফটকের শুরুতেই লনের দু’ধারে সারি সারি স্পাইডার লিলি। ডানে ও বায়ে চলে গেছে ইট বাঁধানো রাস্তা। বামদিকে দুটো পাম গাছ দিয়ে পথ শুরু আর ডান দিকে ফুরুস। সামনে এগিয়ে যেতে চোখে পড়ে ডানে কৃষ্ণচূড়া, কদম, অঞ্জন, সোনালু, আর চালতা গাছ। বায়ে থুজার সারি, স্বর্ণচাঁপা উদ্যান। একটু সামনেই লেক। ৬৫.৫ একর জমি আর ৮.৭৫ একর ঝিলই যে পার্কের স্থাপত্য, তা পুরো পার্কটি না ঘুরলে বোঝার উপায় নেই।

ঝিলের বুকের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাস শরীর আর মনকে এতটাই জুড়িয়ে দেয় যে, ভাবছিলাম ঝিলের পাশের বেঞ্চিগুলোর একটিতে একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। ঝিলের পার এতটাই মুগ্ধ করল যে, কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে তো পড়লই না বরং কোন কাজে যাচ্ছিলাম তা-ই ভুলে গেলাম।

কিন্তু অস্বাভাবিকতা একটা অবশ্যই ছিল। দেখলাম ঝিলের দু’পারেই মানুষ গোসল করছে, কাপড় ধুচ্ছে, সেই ধোওয়া কাপড় উন্মুক্ত পথের পাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে শুকানোর জন্য। ঝিলের মাঝ বরাবর পরিষ্কার থাকলেও পাড়গুলো ছিল অসম্ভব নোংরা। হেন ময়লা-আবর্জনা নেই যা ঝিলের পাড়ে নেই। তারপরও পুরো পার্কটি ঘুরে না দেখা পর্যন্ত যেন শান্তি হচ্ছিল না। ঝিলের পাড় ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে সামনে চলছি আর সবুজের জড়াজড়ি দেখে বারবারই মুগ্ধ হচ্ছি।

আম, কাঁঠাল, চালতা, হ্যামেলিয়া, গাব, জারুল, রুদ্রপলাশ, পলকজুঁই, নাগকেশর, নাগলিঙ্গম, গুস্তাভিয়া, অ্যালমান্ডার ঝাড়সহ নাম না জানা গাছের সারি। সবুজের ঘর-সংসার দেখতে দেখতে নিজেকে সবুজের গৃহে অতিথি বলে মনে হলো। ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম নানা রকম আয়োজনের জন্য জনপ্রিয় স্থান রমনার বটমূলে। কিন্তু যেটাকে বটতলা বলা হয় সেটা তো আদৌ বটতলা নয়! অশ্বত্থতলা। পাশেই রমনা ক্যাফেটেরিয়া। ক্যাফেটেরিয়ার পাশেই শেষ হয়েছে ঝিলটি। ঝিলের প্রান্তে বড়শি পেতে মাছ ধরে শৌখিন মৎস্যশিকারিরা। ঝিলকে পাশে রেখে সামনে এগিয়ে ফটক পেরোলে মৎস্য ভবন।

ক্লান্ত হয়ে বসলাম কংক্রিটের তৈরি বসার জায়গায়। বসে বসেই চারপাশে দেখতে লাগলাম। বাঁধানো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম বড় বড় রঙিন পাথরগুলো গাছের গোঁড়ায় দেওয়ার কারণ কী। এতে তো গাছের শিকড় বেশি বাড়তে পারে না। ইট বিছানো পথ না হয়ে যদি মাটির পথ থাকত আরো বেশি ভালো লাগত। বাঁধানো বলে অনেকেই গাছের নিচে বা ছাউনির ভেতরে বেশ আয়েশ করেই ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মানুষের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে প্রায় দশবার বিভিন্ন জন এলো। কেউ চা-কফি-সিগারেট বিক্রি করতে, কেউ ফুলের মালা, কেউবা ঝালমুড়ি।

ইউটার্ন নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব পাশে আনসারদের থাকার ঘর আর ছোট পরিসরে শিশুদের জন্য খেলার পার্ক। একসময় এই অংশে চিড়িয়াখানাও ছিল, যা পরে মিরপুরে স্থানান্তরিত হয়। সামনের দিকে যত এগোচ্ছি গাছ আর সবুজের নিবিড় সম্পর্ক আর আত্মীয়তার মাঝে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছি, আবার খুঁজেও নিচ্ছি। মুগ্ধতার রেশ আরো বাড়িয়ে দিল ছায়াঘন সুনিবিড় অশোক তলার অবস্থান। বাধানো অশোক তলার ছায়ার মায়ায় আলো-আঁধারির খেলা আর গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের স্পন্দন। পার্কের পূর্ব পাশে অশোকের ছায়াঘন পথ ধরে সামনে এগোলেই রমনা পাকের অরুণোদয় ফটক। সেখানে পাওয়া গেল ‘এক নজরে রমনা পার্কে’র বিবরণী বোর্ড। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

তথ্য আর বানান বিভ্রাটে বেশ বড় রকমের একটা হোঁচট খেলাম। এখানে ৮.৭৫ একর ঝিল ৮০৭ একর ঝিল হয়ে গেছে যেখানে পুরো রমনার আয়তনই ৬৮.৫ একর। জলজ উদ্ভিদের কথা লেখা থাকলেও ঝিলে কোনো জলজ উদ্ভিদের দেখা মেলেনি। হয়তো আগে ছিল এখন নেই। তবে লক্ষণীয় যে, বিবরণীতে দেওয়া তথ্যগুলো ২০০৫ সালের।

পার্কের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পার্কের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দই নেই। গণপূর্ত বিভাগের সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে পার্কটি পরিচালিত হয়। শতাধিক অনুমোদিত জনবল থাকার কথার থাকলেও বর্তমানে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন কর্মরত আছে। তাদের অনেকেই আবার খণ্ডকালীন, অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছে। অনেক বছর ধরে পার্কে জনবল নিয়োগও বন্ধ। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উদ্যোগী হয়ে পার্কের উন্নয়ন করতে চাইলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় তা সম্ভবপর হয় না। ফলে অযতœ, অবহেলা ও পরিচর্যাহীনতার ছাপ স্পষ্টই চোখে পড়ে পার্কের সর্বত্র।
    
রমনা পার্কের রয়েছে নিজস্ব নার্সারি। আছে বিরল প্রজাতির গাছের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এখানে পাওয়া যায়, পালাম, ক্রিমফ্রুট, মাধবীলতা, মালতীলতা, মধুমঞ্জরিলতা, পারুল, কেয়ার মতো আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় ফুল।

দূষিত ঢাকার বুকের ঠিক মাঝখানে বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রশান্তির আয়োজন করে বসে আছে সবুজ-শ্যামল এই রমনা পার্ক। তাই তো শহুরে মানুষগুলো একটু সজিবতা পাবার লোভে, বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসকে উপহার দেবে বলে ছুটে আসে রমনায়। সাত সকালে, অলস বিকেলে কখনো বা গোধূলি বেলাতেও। কিন্তু একটু একটু করে দূষণের থাবা এগিয়ে আসছে এই সবুজের উদ্যানের দিকে।

এখনই যদি সেই থাবাকে হানা দেবার আগেই রুদ্ধ করা না যায় তবে হয়ত অচিরেই আমরা এই সবুজ শ্যামলিমাকে রমনা পার্ক না বলে রমনা বালুচর বা রমনা মরুভূমি নামে চিনব। রমনা পার্ক থাকবে সবুজ-শ্যামল আর পাখির কলকাকলিতে মুখর। কোনো ব্যবসায় কেন্দ্র বা উদ্বাস্তুদের থাকার জায়গা হিসেবে আমরা রমনা পার্ককে দেখতে চাই না। চাই না কনসার্ট, মেলার নামে অনাহূত উতপাত। চাই নির্মল, সুন্দর সবুজাভ রমনা পার্ক।
 
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৩
এএ/জেসিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।