ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

অবহেলায় বেড়ে ওঠা, ফুরসৎ নেই লেখাপড়ায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৩
অবহেলায় বেড়ে ওঠা, ফুরসৎ নেই লেখাপড়ায়

Rafiqul-islamউপকূল ঘুরে: কাজে যাওয়ার বয়স হয়নি বলে ওরা এখনো অবসরে। সময় কাটে নদীর পাড়ে।

নৌকায় কিংবা ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ পরিবেশে। মেতে ওঠেন খেলাধুলায়। স্কুলে যাওয়ার বয়সে ওদের হাতে অনেক অলস সময় পড়ে থাকে।

তবুও স্কুলের চৌকাঠ পেরোনোর সুযোগ হয় না ওদের। সরকারি হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকলেও উপকূলের এ হতদরিদ্র পরিবারে যেন তার ঢেউ এসে পৌঁছায় না।

এ গল্প উপকূলের খেটে খাওয়া পরিবারের শিশুদের। ভোলার রামদাসপুর, দৌলতখান, মদনপুরা, হাজীপুর, চন্দ্রপ্রসাদ, লক্ষীপুরের আলেকজান্ডার, কমলনগরে এমন বহু শিশুর সঙ্গে দেখা মেলে। স্কুলে যাওয়ার বয়সে ওরা খেলাধুলায় সময় কাটায়।

আর কাজে নামার বয়স হলেই কোনো না কোনো কাজে যুক্ত হয়। অনেকে বাবার পথ ধরে মাছধরার নৌকায় যায়। ১৪-১৫ বছর বয়সেই হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি। ২০ বছর পেরোনোর আগেই সংসারের দায়িত্ব ওঠে মাথায়।

প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর সমাজে নানা ধরনের কুসংস্কার এসব শিশুদের বিকাশে বহুমুখী বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। হতদরিদ্র পরিবারের বসতি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিশুদের চিকিৎসায় ভরসা তাবিজ-কবজ। বাবা-মায়েদের বিশ্বাস চিকিৎসকের চেয়ে ফকির-কবিরাজেরাই সন্তান ভালো করে তুলতে অধিক পারদর্শী।

স্কুলে পাঠানোর চেয়ে ৭-৮ বছর বয়সেই মেয়েদের পর্দায় আবৃত্ত করাটাই তাদের কাছে জরুরি। আধুনিক যুগেও উপকূলের হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা এভাবেই পিছিয়ে থাকছে। বের হতে পারছেন না সংকট থেকে। উপকূলের কয়েকটি ছবির দিকে দৃষ্টি ফেরালে এসব চিত্রই ফুটে ওঠে।

স্কুলে যাওয়ার চেয়েও ৭-৮ বছরের মেয়েদের পর্দা জরুরি
পড়নে হাফপ্যান্ট। অথচ মুখমন্ডল আর মাথা থেকে শুরু করে গোটা শরীর পর্দায় ঢাকা। কোনোমতে চোখ দুটো দেখা যায়। এক জনের নাম সুমি। অন্যজনের জোনাকি। স্কুলে যায়নি কোনোদিনও। বাবা নদীতে মাছ ধরে। ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় দেখা গেল পর্দায় ঢাকা এ দুই শিশুর। এভাবে দিন অতিক্রম করে অল্প বয়সেই হয়তো ওরা একদিন অন্য ঘরে পা ফেলবে।

রোগ-বালাইয়ে ভরসা তাবিজ-কবজ
উপকূলের হতদরিদ্র পরিবারে শিশুদের রোগবালাই সারাতে তাবিজ-কবজই ভরসা। এসব পরিবারের অভিভাবকদের ধারণা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার চেয়ে ফকিরের কাছে যাওয়াটাই বেশি নিরাপদ। তাইতো সন্তানদের সর্দি-কাশি-জ্বর-হাপানি ছাড়াও বিভিন্ন রোগ সারাতে ফকির-কবিরাজের কাছে ছুটে এসব অভিভাবকেরা। ভোলা সদরের চন্দ্রপ্রসাদ গ্রামে দেখা মিলল গলায় তাবিজ পড়া শিশুদের।

অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা
কথা বলা তো এখনো শিখেনি। তারপরও এক জনের সঙ্গে আরেকজনের কী কথা? একজন তো হাত নেড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। অন্যরা শুনছে। ভোলার দৌলতখানের সৈয়দপুর এলাকায় এ কোমলমতি শিশুরা খেলছিল বেড়িবাঁধের পাশে। স্কুলে যাওয়ার বয়স ওদের এখনো হয়নি। তবে বয়স বাড়লে কী ওরা স্কুলে যেতে পারবে? নিয়তি ওদের কোনদিকে নিয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই ওদের কাছে।

ওদের বিনোদন চায়ের দোকানে টেলিভিশনে সিনেমা দেখা  
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের শিশুরা বেড়ে ওঠে এভাবে। সারাদিন রাস্তায় ধুলোমাটিতে খেলাধুলা শেষে বিকালে ওরা একটু অবসর নেয়। আর সেই অবসর সময়টা কাটে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের টেলিভিশনে সিনেমা দেখে। কিন্তু সন্তান কোথায় আছে, কী করছে, দেখার কোনো প্রয়োজন নেই অভিভাবকের। বাবা-মায়ের ধারণা তাদের সন্তানেরাও বড় হয়ে একদিন কাজে যোগ দেবে। সংসারের হাল ধরবে। তাই স্কুলে পাঠানোর চিন্তাও তারা করেন না।

মায়ের কোলে থাকার সময়টুকুই নিরাপদ সময়
জন্মের পর মায়ের কোলে থাকার সময়টুকুই যেন এ শিশুদের কাছে নিরাপদ। ওদের শৈশবে জৌলুসের দেখা নেই। খেয়ে-নাখেয়ে থাকা পরিবারে বেড়ে ওঠে ওরা। বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপেই বিপদ। একটু বড় হলে মায়ের কোল থেকে বাইরে বের হওয়ার পর এ শিশুদের দেখার কেউ থাকে না। রামগতির আলেকজান্ডারে মা হাসিনা বেগমের কোলে শিশু সাইফুলের চোখ হয়তো অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু পারবে কী? সে প্রশ্নের জবাব জানা নেই কারো।

কন্যাশিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ মেলে না
এইতো কদিন আগেই ছিল কন্যাশিশু দিবস। কন্যাশিশুদের কল্যাণে ঘটা করে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হয় এ দিবস। কন্যাশিশুদের এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নানা সেøাগান আর বক্তৃতা হয়। আসলে কতটুকু বদলায় কন্যাশিশুদের জীবন। লক্ষীপুরের রামগতির আলেকজান্ডারের হতদরিদ্র পরিবারের কন্যাশিশু মালা বেগমের অবস্থা বদলায় না। বিকালে হাড়িপাতিল নিয়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে সে। আর দশজন মেয়ের মতো তারও স্কুলে যাওয়া হয় না। ঘরে ঠিকমতো তিনবেলা খাবারও পায়না সে। মালার মুখের এ প্রাঞ্জল হাসিটা আর কতদিন থাকবে?

নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রশিক্ষণ
কর্মজীবনে প্রবেশের আগে ওরা প্রশিক্ষণ নেয়। বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের সঙ্গে যায় নৌকায়। ঠিক নদীতে মাছ ধরতে নয়, নৌকাটি ঘাটে বাঁধা থাকাকালে ওরা সেখানে গিয়ে দেখে দেখে কাজ শেখার চেষ্টা করে।

জাল মেরামতের সুতা, নৌকা বাঁধার দড়ি কিংবা নৌকা চালানোর বৈঠাটা ধরে ওরা খেলতে থাকে। খেলতে খেলতেই একদিন নৌকার বৈঠা ধরে ফেলে ওরা। অভিভাবকদের কাছে স্কুলে যাওয়ার চেয়েও অবসরে নৌকায় এসে প্রশিক্ষণ নেওয়া এসব শিশুদের জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। ছবিতে লক্ষীপুরের আলেকজান্ডারে ঘাটে বাধা নৌকায় একদল শিশুর বিকালে অবসর কাটানোর দৃশ্য।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।