ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

পানিবন্দি জরাজীর্ণ জীবন, নদী খননেই মুক্তি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৩
পানিবন্দি জরাজীর্ণ জীবন, নদী খননেই মুক্তি

কানাইদিয়া (জালালপুর, তালা, সাতক্ষীরা) থেকে: ওই আমাগে বাড়িঘর তলায়ে নইছে। আমাগে সব কিছু শেষ হইয়ে গেছে।

আমাগে খাবার চাই। থাকার জায়গা চাই। কাজ চাই। পালি খাই না, পালি জোটে না। ত্রাণ চাই না। পানি সরাও।

বাড়ির পাশে কাঁচা রাস্তার ওপরে আশ্রয় নেওয়া সরদার জিয়াউর রহমান নিজের ঘর গোছাতে গোছাতে এভাবেই সরেজমিন বাংলানিউজকে জানালেন পানিবন্দি জীবনের নানামুখী দুর্দশার কথা। জালালপুর ইউনিয়নের কানাইদিয়া গ্রামে নিজের পাকা ঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে উঠেছেন রাস্তায়।

পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বানিয়েছেন ঝুপড়ি। এখানেই গাদাগাদি করে থাকেন পরিবারের সবাই। থাকার সমস্যা হওয়ায় স্ত্রী আর সন্তানদের পাঠিয়েছেন শ্বশুড়বাড়ি।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের কানাইদিয়া গ্রামের বানভাসি জিয়াউর রহমানের মতো অবস্থা ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার পরিবারের। এ এলাকায় বৃষ্টিজনিত বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। ধসে গেছে কাঁচা বাড়িঘর।

এবার এ এলাকায় বিভিন্ন ফসলের ভালো ফলন হলেও কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেনি কিছুই। জলাবদ্ধ এলাকার যেদিকে চোখ যায় শুধুই পানি আর পানি। বাড়িগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় বহু মানুষ বাঁধের ওপর কিংবা অন্যত্র উঁচু স্থানে ঠাঁই নিয়েছেন। বহু মানুষের মাটির ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। পিচঢালা সড়ক পুরোপুরি ডুবে আছে পানির নিচে।

সূত্র বলছে, জলাবদ্ধতা কবলিত তালা উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবারের ৮০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। ফসলি, বাড়িঘর, মাঠঘাট সব কিছু পানিতে ডুবে থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। কাজ না থাকায় তিনবেলা ভাত জোটানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।

উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া সামান্য পরিমাণ সাহায্য বিতরণ করা হয়েছে। এর পরিমাণ পরিবার প্রতি পাঁচ কেজি চালের বেশি নয়। তবে জলাবদ্ধ এলাকার মানুষেরা ত্রাণ চান না। পানি অপসারণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার দাবি তাদের।  

ভর দুপুরে কানাইদিয়া বলাইর মোড়ে ডুবে থাকা পিচঢালা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু নৌকা। এ নৌকাগুলোই জলাবদ্ধ এলাকায় এবাড়ি থেকে ওবাড়ি, এ গ্রাম থেকে ওগ্রামে যাওয়ার একমাত্র ভরসা। অনেকে কোমর কিংবা গলা পানি পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। দূরের গ্রাম থেকে খাবার পানি আনা, লাকড়ি সংগ্রহ, দোকান থেকে সদ‍াইপাতি আনা, সবই চলে এভাবে।

কানাইদিয়ার ডুবে থাকা বাড়িঘরের তথ্য সংগ্রহে শওকত গাজীর নৌকায় যাত্রা। নৌকায় ওঠা ১৪ জন যাত্রীর সবার বাড়ি ডুবে থাকায় এখন রাস্তায় ঝুঁপড়িতে থাকেন। পিচঢালা রাস্তা, পুকুর, ডোবা, ধানক্ষেত, বাড়ির আঙ্গিনার ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যায় নৌকা।

এসব নৌকা থেকেই পরিস্কার পানির ভেতরে স্পষ্টই দেখা যায় ধানের শীষগুলো। মাসখানেক পরেই এগুলো ঘরে তোলা যেতো। কিন্তু জলাবদ্ধতা সে সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। নৌকা থেকে নেমে সুপারি গাছ আর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আরও কিছুদূর কানাইদিয়ার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার একাংশ।    

সাঁকো থেকে নামতে না নামতেই জলাবদ্ধ এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিল গাজী পথ আটকালেন। বলতে চান কষ্টের কথা। পানি তার ঘর ছুঁই ছুঁই। তবে ঘর থেকে বের হতেই পানির দেখা মেলে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হলে প্রয়োজন সাঁকো। ডুবে থাকা নলকূপে গোসল করতে গেলেও এ সাঁকোই ভরসা।

জলিল গাজী বললেন, পর পর তিন বছরের জলাবদ্ধতায় আমার সব তলিয়ে গেছে। গাছ মরে যাচ্ছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। আমরা ত্রাণ চাই না। পানি সরানোর ব্যবস্থা করুন। ঠিকঠাকভাবে কপোতাক্ষ খনন করলেই পানি সরে যাবে। পানি নেমে গেলে আমরাও বাঁচি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জলাবদ্ধ এলাকার বহু সড়ক পানিতে ডুবে আছে। একবাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে নৌকা অথবা সাঁকেই একমাত্র ভরসা। বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ডোবানালা, ফসলি জমি সবই তলিয়ে গেছে পানিতে।

একদিকে পানি সরতে পারছে না। অন্যদিকে অবিরাম বর্ষণে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ শুধুই বাড়ছে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া ছাড়াও বিভিন্ন রোগ দেখা দিলেও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। তুলনামূলকভাবে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি।

স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলানিউজকে কাছে পেয়ে জানালেন, জোয়ারের সঙ্গে আসা পলিমাটিতে ভরাট হয়ে গেছে সাতক্ষীরা জেলার বেতনা কপোতাক্ষ নদ। এর তলদেশ এখন আশাপাশের কৃষিজমি থেকে দু থেকে তিন ফুট উঁচু। স্লুইচগেটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী দিয়ে জমে থাকা পানি সরতে পারছে না।

অতিবৃষ্টিতেই পানি উপচে ভাসিয়ে দেয় বাড়িঘর ও ফসলি মাঠ ছাড়াও সবকিছু। তিন বছর ধরে এ মৌসুমে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। অতিবৃষ্টির কারণে এবারের অবস্থা খুবই নাজুক। প্রায় দুমাস আগে থেকে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমতে শুরু করেছে।

তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু বাংলানিউজকে বলেন, ইউনিয়নের দুই হাজার পরিবার জলাবদ্ধতার মধ্যেই জীবনযাপন করছেন। প্রায় তিন মাস ধরে পানি বেড়েই চলেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় ত্রাণ হিসেবে সামান্য পরিমাণ চাল পাওয়া গেছে। এ মুহূর্তে সমস্যা সমাধানে নদী খনন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।