ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

সিডর-আইলা প্রলয়, জীবন ফেরেনি আলোয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
সিডর-আইলা প্রলয়, জীবন ফেরেনি আলোয়

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় জনপদ।

এর আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। গৃহহারা হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। সমুদ্রে মাছধরারত বহু জেলের আর স্বজনদের কাছে ফেরা হয়নি।

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বয়ে গিয়েছিল এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এ রেশ না কাটতেই মাত্র দু বছর ২০০৯ সালের ২৫ মে উপকূলে আছড়ে পড়ে আরেক ঘূর্ণিঝড় আইলা। এখন কেমন আছে সিডর আর আইলা বিধ্বস্ত জনপদের মানুষেরা? সিডরের ৬ বছর পূর্তিতে তারই খোঁজে বাংলানিউজ।

কালিনগর(কামারখোলা, দাকোপ, খুলনা) থেকে: কেউ বাঁধের ওপর, কেউ অন্যের জমিতে, আবার কেউবা পরিবার পরিজন নিয়ে নদীর ধারে খোলা স্থানে ঘর বানিয়ে কোনোমতে মাথা গুঁজে আছে। কেউ হারিয়েছে ফসলি জমি, কেউ ঘরবাড়ি, আবার কেউবা হারিয়েছে চিংড়ি খামার। অবশিষ্ট নেই কিছুই। সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা বাড়িটি এখন যেন শুধুই স্মৃতি।

এ দৃশ্য সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত খুলনার দাকোপের কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের। সরকার-এনজিও শত চেষ্টা করেও সিডর আর আইলা বিধ্বস্ত জনপদের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেনি। এ দুই ঘূর্ণিঝড়ের পরেই এসব এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ও দাতাদের তরফে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা এসেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের টেকসই জীবন নিশ্চিতে তা তেমন কাজে লাগেনি।

এলাকাবাসী বলেছেন, সাময়িক সাহায্য পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা সংকট অতিক্রম করেছে। ঘর নির্মাণ ছাড়াও পুনর্বাসন খাতে পাওয়া সাহায্যটুকু সংকটের ধকল সামলাতেই ফুরিয়ে গেছে। কর্মসংস্থান পাওয়া কিংবা ক্ষেতে ফসল পাওয়া অবধি সাহায্য অব্যাহত থাকলে মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারতো।

সিডর-আইলায় খুলনার দাকোপ উপজেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কামারখোলা ও সুতারখালি ইউনিয়ন। পূর্বে ভদ্রা, পশ্চিমে ঢাকী ও শিবসা, উত্তরে ঢাকী ও ভদ্রা এবং দক্ষিণে ভদ্রা ও শিবসা নদী ইউনিয়ন দুটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

প্রথমবার সিডরে এ এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর দু বছর যেতে না যেতেই আইলার প্রলয় সিডরের ক্ষত আরও বাড়িয়ে দেয়। দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে না পেরে এলাকার বহু মানুষ কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যায়।

নদী পেরিয়ে কামারখোলা ইউনিয়নে পৌঁছাতেই নদীর ধারে ও বাঁধের পাশে চোখে পড়ে বহু বিপন্ন মানুষের বসতি। কেউ নতুন করে ঘর বুনছে, কেউবা ঘর মেরামতে ব্যস্ত। দাকোপ খেয়াঘাট থেকে কামারখোলা ইউনিয়নের কালিনগর বাজার অবধি প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথে একই দৃশ্য চোখে পড়ে। আর কালিনগর বাজারে মানুষের কষ্টের কথা জানতে গেলে অভাব-অভিযোগ জানাতে ভিড় জমে বহু মানুষের।

কামারখোলার সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কালিপদ মিস্ত্রির ঘর আইলার স্রোতে ভেসে গেছে। পুকুর ডুবে গেছে। দু বছর ধরে জমিতে ফসল হয়নি। দুর্যোগের পর কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলেও তা ওই সময়ই শেষ। এখনো ঘর তুলতে পারেননি। দেনা আছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। এর আগে সিডরেও তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।

চান্নির চক এলাকার বাসিন্দা অসীম কুমার রায়ের ৫৩ শতাংশ জমি ভেঙে গেছে আইলার স্রোতে। চাষাবাদের জন্য মাত্র ছয় বিঘা জমি আছে। বাড়ি বানানোর জমি নেই। থাকেন অন্যের জমিতে। সিডরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আইলা তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।

সরেজমিন বাংলানিউজকে এলাকাবাসী বলেন, সিডর-আইলার পর এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ নিজেরাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আইলায় গোটা এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় দু বছর কোনো ফসল হয়নি। গত বছর প্রথমবার ধান আবাদের চেষ্টা চলে। কিন্তু ফলন মার খেয়েছে। মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। অনেক স্থানে বালু স্তুপ আকারে জমে আছে। এসব কারণে আবাদি জমির ৬০ ভাগ এখনো পতিত রয়ে গেছে।

কামারখোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সমরেশ রায় বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগের পর মানুষ চরম সংকটে পড়ে। তাদের তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ক্ষতিগ্রস্তরা ঘর বানানোর জন্য ২০ হাজার টাকা করে সরকারি সাহায্য পেলেও তা সংকট কাটাতেই খরচ হয়ে গেছে। তাই আর ঘর বানানো হয়নি। অনেকে ধারদেনা করে দু বছর জমি আবাদ করেছে। কিন্তু ফসল মার খাওয়ায় আবার নতুন করে দেনায় জড়িয়েছেন।

কামারখোলার কালিনগর থেকে জালিয়াখালী যেতে দীর্ঘ হাঁটা পথে কথা হয় বহু ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সঙ্গে। কারো আবার আইলায় বিধ্বস্থ ঘরখানা এখনো পড়ে থাকতে দেখা যায়। অর্থের অভাবে সংষ্কার করা সম্ভব হয়নি। বাড়িঘরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহু মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে ছুটেছে। জালিয়াখালীতে অন্তত অর্ধশত পরিবার এখনো বাঁধের ওপর ঘর বানিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ১৫ নভেম্বর, ২০০৭। দীর্ঘ ছয় বছর আগে আজকের দিনে উপকূলের জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। বদলে দেয় উপকূলের মানুষের জীবন। বহু মানুষ সব হারিয়ে পথে বসে। এর মাত্র দু বছর কাটতে না কাটতেই আইলা আঘাত হানে ২০০৯ সালের ২৫ মে। সিডর-আইলার মতো নানা দুর্যোগ এভাবেই উপকূলের মানুষদের ঘরছাড়া করেছে। সে জীবনে আজও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এনএস/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।