ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

সারা বিশ্বে বাড়লেও বাঘ কমছে বাংলাদেশে

মাহবুব আলম, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
সারা বিশ্বে বাড়লেও বাঘ কমছে বাংলাদেশে ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: নানামুখী সংরক্ষণ উদ্যোগে সারাবিশ্বেই এখন বাঘের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। ২০১০ সালের বাঘ সম্মেলনে এ বিষয়ক বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার পর গত ৭ বছরে অনেক বনেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে বাঘের সংখ্যা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বব্যাপী এ সাফল্যের পথে হাঁটতে পারেনি বাংলাদেশ।

এ দেশের গর্ব ও আইকন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা তাই আশঙ্কাজনকভাবে কমছে তো কমছেই।  
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশে।

আর বাকিটা পড়েছে ভারতে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কত সে হিসাব নেই বন বিভাগের কাছে। যদিও ২০১৫ সালের গণনায় ১০৬টি বাঘের কথা বলা হয়েছিল।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও সরকারের বন বিভাগ পায়ের ছাপ গণনার পদ্ধতি (পাগমার্ক) প্রয়োগ করে জরিপ চালিয়ে সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ আছে বলে জানায়।  

সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ।  ফাইল ফটো পরে ২০১৫ সালে বাঘের উপর আরেকটি জরিপ চালায় বন বিভাগ। ক্যামেরায় ছবি তুলে করা ওই জরিপে বেরিয়ে আসে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬।  

এর আগে ২০০৬-০৭ সালে ক্যামেরা ট্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি জরিপ চালিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক মনিরুল এইচ খান।  

ওই জরিপের প্রতিবেদনে, সুন্দরবনে ২০০ বাঘ আছে বলে জানানো হয়।  এ ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গত এক দশকে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।  

ছবি: সংগৃহীতএ বিষয়ে জাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বাংলানিউজকে বলেন, ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছিল, পরবর্তী ১০ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশ বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। এরই মধ্যে এর ৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে।  

‘পার্শবর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ছাড়াও রাশিয়ায় দ্বিগুণ না হলেও বাঘের সংখ্যা বেড়েছেই ঠিকই। কিন্তু এর উল্টো আমাদের দেশে। এখানে কমেছে। ’

তিনি বলেন, প্রকল্পভিত্তিক ও বিদেশি অর্থায়নে বাঘ রক্ষার  উদ্যোগ নেওয়া হয়। কোনো প্রকল্পই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু এভাবে বাঘ রক্ষা সম্ভব নয়। এ জন্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

‘সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় একটি পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এটি পাস হলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া অনেকটা সহজ হবে। ’

সুন্দরবনে চোরাশিকার ও কীটনাশক প্রয়োগে বাঘ হত্যা বন্ধ করাও জরুরি বলে মনে করেন অধ্যাপক মনিরুল।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় বিপন্ন প্রাণী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। চোরাশিকার ও বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনে বাঘ হত্যার কথা উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনেও।  
 
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজের করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ফসলের কীটনাশক দিয়ে সুন্দরবনের বাঘ মারা হচ্ছে। বাঘ হত্যা করতে অতি সম্প্রতিকাল ধরে এ ফাঁদ ব্যবহার করছে দুর্বৃত্তরা। হরিণ মেরে তাতে ফুরাডন দিয়ে বনে টোপ হিসেবে রেখে দেওয়া হয়, আর সেই ‘খাবারে’র ফাঁদে পড়ে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সুন্দরবনের বাঘ মারার পার এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে পাচার করা হচ্ছে। যেভাবে বাঘ হত্যা করা হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে খুব দ্রুত এই প্রাণী সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

গবেষণা প্রসঙ্গে ড. আবদুল আজিজ বাংলানিউজকে জানান, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে সরেজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়। ওই সময় ফুরাডন বিষ মাখানো মোট ছয়টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের দোবেকি বন ফাঁড়ির কাছে বাঘের মৃতদেহের কিছু অংশ ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছে।  

তিনি বলেন, বাঘের জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করা বিষ মাখানো হরিণের মৃতদেহ ল্যাবে পরীক্ষা করে জেনেছি যে. এটা ফসলের দানাদার কীটনাশক ফুরাডন। নীল রঙের এই কীটনাশক ফসলের কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করেন কৃষকরা।  

মূলত বিষ মাখানো হরিণের মাংস খেয়েই বাঘ মারা যাচ্ছে উল্লেখ করে জাবি শিক্ষক আবদুল আজিজ বলেন, ডাকাত ও তাদের সঙ্গে যুক্ত লোভী জেলেরা এসব বিষটোপ দিয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন সময় যে কটি বাঘের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তা মারা পড়া বাঘের বড়জোর ২০ শতাংশ। অন্যগুলো হয়তো বিভিন্নভাবে পাচার হয়ে গেছে।  

বাঘের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে চীনসহ আশপাশের দেশে ওষুধ, চামড়া দিয়ে সৌখিন দ্রব্য এবং হাড় দিয়ে ওয়াইন তৈরি হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।  

জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার বাঘন রয়েছে। আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে তিনটি একেবারেই বিপন্ন। শুধু সুমাত্রা, সাইবেরিয়া, রয়েল বেঙ্গল, মালয়, ইন্দোচীন এবং দক্ষিণ চীনের বাঘই টিকে আছে।  

ছবি: সংগৃহীতএ বিষয়ে বন বিভাগের খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী জানান, বন বিভাগের সহযোগিতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুন্দরবনে টহল জোরদার করেছে। ফলে গত এক বছরে সেখানে কোনো বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে বাঘের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও গড়ে তোলার কথা বলেছেন সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বাঘ কমে যাচ্ছে-এটা সত্যি। তবে কি কারণে কমছে এর প্রকৃত কারণ উদঘাটন নিয়েও কাজ করতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
এমএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।