ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

নেবে গোলাপি সাদা হাওয়াই মিঠাই...

নাজমুল হাসান, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৫
নেবে গোলাপি সাদা হাওয়াই মিঠাই... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাওয়াই মিঠাই নেবে... হাওয়াই মিঠাই....মিষ্টি নরম গোলাপি সাদা হাওয়াই মিঠাই...। এই হাঁক শুনলেই শৈশবে ছুটে বের হয়ে যেতাম ঘর থেকে।

২৫ পয়সা থেকে ১ টাকা খরচ করলেই মিলতো কয়েক পিছ। মাঝে মধ্যে আবার পুরনো ভাঙারি জিনিসেও মিলতো। কাচঘেরা বাক্সে ছোট ছোট গোল হাওয়াই মিঠাই রাখা হতো। মুখে দিলেই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যেতো, তবু মুখে যে স্বাদ লেগে থাকতো তার অনুভূতি ছিলো চমৎকার।

কালের পারিবর্তনে বদলেছে অনেককিছুই। মানুষের খাদ্যাভাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলে গেছে খাবারও। বিশেষ করে ফেরি করে বিক্রি করা খাবারে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আধুনিক ফাস্টফুডসহ নানা খাবারের তোড়ে অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে মিষ্টি খাবার হাওয়াই মিঠাই। তবু মাঝে মধ্যে দেখা মেলে কোনো পার্ক, জনজমায়েত অথবা বিভিন্ন মেলায়।

লম্বা কাঠির মাথায় পলিব্যাগে মোড়ানো গোলাপি সাদা হাওয়াই মিঠাই। ঘাড়ে করে ‍ঘুরে বেড়ায় ফেরিওয়ালা।

কিছু কিছু ব্যবসায়ী আজও এই হাওয়াই মিঠাইকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেয়নি। বংশ পরাম্পরায় ব্যবসা চালিয়ে আসছেন তারা। এত খাবারের ভিড়েও চাহিদা কিন্তু মোটেও কমেনি এ খাবারটির। শিশুরা বেশি পছন্দ করলেও বড়রাও কম যায় না।

রাজধানীর কিছু কিছু জায়গায় গেলে আজও দেখা মিলবে গুটিকয়েক হাওয়াই মিঠাই কারিগরের। যারা ২০-৩০ বছর ধরে পরিবারিকভাবে হাওয়াই মিঠাই বানিয়ে আসছে। তেমন একজন মুসলিম মিয়া। তিনি ধানমন্ডি রায়ের বাজার এলাকায় থাকেন।

মুসলিম মিয়া বলেন, আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে যে পরিমাণ হাওয়াই মিঠাই ফেরি করে বিক্রি করতাম এখন আর তেমন বিক্রি হয় না। ঢাকা শহরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ধানমন্ডি লেক, শিশু পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, সংসদ ভবন এবং আরও কয়েকটা জায়গা আছে যেখানে গেলে কিছুটা বিক্রি হয়।

আগের বেচা-কেনা ও বর্তমান বেচা-কেনার পার্থক্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে ৪ থেকে ৫ কেজির চিনির জিনিস তৈরি করতাম। সঙ্গে মেশিন নিয়ে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ফেরি করে চলতাম। এখন নিজ বাসা থেকে ৭০ থেকে ৮০ পিছ হাওয়াই মিঠাই বানিয়ে বাইরে বিক্রি করতে যাই। আগের মতো তেমন কাস্টমার নেই, তাই মেশিন সঙ্গে নিয়ে বের হই না।

তিনি আরও বলেন, আমারা যারা হাওয়াই মিঠাইয়ের ব্যবসা করি তারা মূলত দুই ধরনের হাওয়াই মিঠাই তৈরি করি। একটি সাদা রঙের, অপরটি গোলাপি। সাদাটা প্রতি পিছ তৈরি করতে আমার ২৫ গ্রাম চিনি খরচ হয়। এতে চিনিসহ অন্য খরচ মিলিয়ে ৫ টাকার মতো খরচ হয়। আর বিক্রি করি ১০ টাকা করে প্রতি পিছ। ১ কেজি দিয়ে ৫০ পিছ তৈরি করতে পারি। গোলাপিটার খরচ একটু বেশি পড়ে। কারণ ওইটার সঙ্গে খাবারের যোগ্য গোলাপি রং মেশাতে হয়। গোলাপি প্রতি পিছ তৈরি করতে ৬ থেকে ৭ টাকা খরচ হয়, কিন্তু ১০ টাকা করেই বিক্রি করি। গোলাপি হাওয়াই মিঠাইতে লাভ একটু কম হয়।

হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে প্রতিদিন কেমন লাভ হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে মুসলিম মিয়া বলেন, প্রতিদিন ফেরি করে ৭০ পিছ হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করতে পারি। কোনো কোনো দিন একটু কম হয়। যদি ৭০ পিছ বিক্রি করতে পারি তাহলে আয় হয় ২১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা চিনি কেনা ও মেশিনের আনুষঙ্গিক খরচ হয়।

এই টাকা দিয়ে সংসার চলে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু এ কাজে কোনো কর্মচারীরর প্রয়োজন হয় না, তাই ব্যবসা করে যা লাভ হয় তা দিয়ে স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়ে নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে যায়।

রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা তানভির আহমেদ (৩৩) বলেন, যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রাম-গঞ্জে ও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় হাওয়াই মিঠাই ফেরি ওয়ালাদের দেখতাম। টাকার বিনিময়ে হাওয়াই মিঠাই কেনা গেলেও ফেরিওয়ালারা মূলত পুরনো কাগজপত্র, ছেঁড়া স্যান্ডেল, জুতা, নষ্ট সরঞ্জামাদির বিনিময়ে কোনরকম মাপজোক ছাড়াই এই খাবারটি বিক্রি করত। না হতো কাগজপত্রের ওজন, না হতো খাবারের কোনো পরিমাপ!

কামরাঙ্গীচরের থাকেন সুমন দাশ ( ৩৮ )। যার পারিবারিক বাবা-দাদারা থেকেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মেশিন তৈরি করে আসছে। বর্তমানে সুমন নিজে হাওয়াই মিঠাইয়ের মেশিন তৈরি করেন।

সুমন বলেন, আমার বাবা-দাদা হাওয়াই মিঠাই তৈরির মেশিন বানাতো। আগে অনেক অর্ডার আসত। মাসে ১০ থেকে ১২টা মেশিনের অর্ডার লেগেই থাকত। প্রতিটি মেশিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। বর্তমানে তেমন কাজ পাই না। মাসে দুই থেকে তিনটি অর্ডার থাকে। কিন্তু আগের দামে আর মেশিনগুলো বিক্রি করা যায় না। মেশিনগুলো লোহা আর টিনের সাহায্যে তৈরি করতে হয়। প্রতি মিশন তৈরিতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। আর বিক্রি হয় করতে হয় বর্তমানে ১০ থেকে ১২ টাকার মধ্যে।

সুমন দাশ আরও বলেন, আমার বাবা-দাদার আমলে এই মেশিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। কারণ ওই সময় এই ব্যবসার অনেক কদর ছিল। ফেরিওয়ালাদের ব্যবসাও ভালো হতো। তাই তারা অনেক মেশিনের অর্ডার দিত। কিন্তু এখন আর এই ব্যবসা নেই বললেও চলে। তাই মেশিন তৈরি ব্যবসার পাশাপাশি অন্য ব্যবসাও করছি। তা না হলে সংসার চালানো যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।