ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘বাঁশের সাঁকোর কারণে মা-বাবাকে ফিরে পাই’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৫
‘বাঁশের সাঁকোর কারণে মা-বাবাকে ফিরে পাই’ ছবি: সোহাগ- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ময়মনসিংহের একটির গ্রামের ৫/৬ বছরের দুরন্ত শিশু আব্দুল জলিল। এ বয়সে এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করতেই যেন মন চায়।

মা-বাবার শাসনে বেড়ে ওঠা, তখন থেকেই অভিভাবকদের ভয় পাওয়া শুরু হয়। হঠাৎ একদিন ছোট একটি ঘটনার কারণে মা-বাবার কাছ থেকে হারিয়ে যায় জলিল। এরপর দীর্ঘ ১১ বছর মা-বাবার কথা মনে পড়লেও তাদের নাম মনে করতে পারেনি জলিল। জলিলের মুখেই শোনা যাক তার কাহিনী...
 
‘আমার বয়স তখন ৫/৬ বছর হবে। একদিন পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে পাশের বাগানে আম কুড়াতে যাই। এ সময় বাগানের মালিক লাঠি নিয়ে আমাদের তাড়া করে, সেখান থেকে দৌঁড়ে পালাই। বাগানের মালিক নিশ্চয় বাড়িতে আমার মা-বাবার কাছে এ নিয়ে নালিশ করবে -এমন আশঙ্কায় ওই দিন আর বাড়িতে যায়নি। ’ 
 
ওই দিন বিকেলে একটি গাড়িতে উঠি। সেটি কোন গাড়ি ছিল এখন মনে নেই। এরপর ট্রেনে। তারপর দেখি গভীর রাতে নতুন এক জায়গায় পৌঁছে গেছি, সিলেট! বেশ কিছু দিন সেই শহরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। কেউ কিছু দিলে খাই, না দিলে উপোস থাকি। সেই সময়ে কত সাল ছিল মনে নেই, তবে এরশাদের শাসন চলছিল।
 
এর মধ্যে একদিন একটি দোকানে কাজের সুযোগ পাই, মালিক তিন বেলা খাবার দেয়। এভাবে চলে যায় ৩/৪ বছর। এরপর একদিন আরেক ট্রেনে করে ঢাকায় চলে আসি। তখন আমার বয়স আনুমানিক ৮/৯ বছর। ঢাকা এসে টোকাই দলে যোগ দেই। এর কয়েক দিনের মধ্যে রাস্তার একটি খাবার হোটেল থেকে পানি নিয়ে স্টেশনে বিক্রি করি, সন্ধ্যায় মালিককে টাকা বুঝিয়ে দিই।
 
কখনো কখনো মালিকের কাছ থেকে ৪/৫ টাকা চেয়ে নিয়ে টোকাই বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। শুধু ঢাকাতেই নয়, টঙ্গি, গাজীপুরেও যেতাম। সেই সময়ে মনে যখন যা চাইতো তাই করতাম। এভাবে কাটলো আরো কয়েক বছর।
 
এরপর আরেক দোকানে হোটেলে চাকরি নিই। কাজ করি, খাই। ৫/১০ টাকা দরকার লাগলে মালিকের কাছ থেকে চেয়ে নিই।
 
এভাবে দিন যায়, রাত যায়। হঠাৎ একদিন মায়ের কথা মনে পড়লো, বাবা, ভাই-বোন, তাদের কথাও। তখন আমার বয়স ১৬/১৭ হবে। মায়ের কথা মনে করে কান্নাকাটি করি, চোখে পানি চলে আসে। বাবার কথা মনে পড়ে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও মা-বাবার নাম মনে করতে পারছিলাম না। আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহ, সেটা মনে করতে পারলেও গ্রাম ও অন্যান্য ঠিকানা ভুলে গেছি। তবে বড় ভাইয়ের নাম মনে ছিল, আমিরুল ইসলাম।
 
গ্রামের কথা মনে পড়ত। বাড়ি যেতে দুইটি বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। একদিন মালিকের কাছ থেকে টাকা চাই। মালিককে বললাম, বাড়ি যাব। এরপর তিনি ৫০০ টাকা দেন, এছাড়া গাড়ি ভাড়া দেন আরো ৬০ টাকা। তিন বছর কাজ করে মালিক এই টাকা দিলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়।
 
ময়মনসিংহ যাই। বাস থেকে নেমে বিভিন্ন দিকে হাঁটাহাঁটি করি, এ সময় দেখি, সব পথ অচেনা, সব মানুষ অপরিচিত। মানুষকে জিজ্ঞেস করি মাটির রাস্তাটা কোথায়, দুইটা সাঁকো পার হতে হয়, কিন্তু কেউ বলতে পারে না। লোকজন জানতে চায়, কার বাড়িতে যাব? কিন্তু মানুষের কথার কোনো উত্তর দিতে পারিনা, বাবা-মায়ের নাম বলতে পারিনা। শুধু বলেছি, আমিরুল ইসলাম আমার বড় ভাই।
 
এভাবে একদিন ঘুরাঘুরি করে বাড়ি, মা-বাবা, ভাই-বোনদের না পেয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসি। ঢাকায় ফিরে আবারো কান্নাকাটি শুরু করি। এরপর থেকে কিছুই ভালো লাগতো না। তখন মায়ের কথা আরো বেশি বেশি মনে হতে লাগলো। মায়ের চেহারাটাই মনে পড়ছিল।
 
এর কিছু দিন পর আবার চিন্তা করলাম বাড়ি যাবো, ফের ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা দিই। বাস থেকে নেমে এবার অন্য দিকে হাঁটতে থাকি, কয়েক ঘণ্টা বিভিন্ন দিক হেঁটে হেঁটে একটি মাটির সড়ক পাই, পরপর বাঁশের দুইটি সাঁকোও পেয়ে যাই। তখন মনে আশা জাগলো বাড়িতে মনে হয় পৌঁছে গেছি।  
 
তারপর পৌঁছে যাই সোজা বাড়িতে। সেই বাড়িতে গিয়ে লোকজনকে বলি আমিরুল ভাইয়ের কথা। আমার বড় ভাই নিজেই তার পরিচয় দেয়। বাড়ির লোকজন জড়ো হয়। আমার নাম বলি আব্দুল জলিল। তখন ঘরের ভেতর থেকে আমার মা দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমিও মাকে জড়িয়ে ধরি।
 
পরে বাবা আসেন, বাবাও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন। শতশত মানুষ আমাদের বাড়িতে ভীড় করে। তখন মা-বাবার কাছে জানতে পারি আমরা চার ভাই ও তিন বোন। এভাবে ১১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মা-বাবাকে পাই।
 
এর কিছু দিন পর ঢাকা আসি, হকার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় মালামাল বিক্রি করি। মাঝে মাঝে বাড়িতে যাই, মা-বাবাকে দেখে আবার চলে আসি। এর কয়েক বছর পরে মা-বাবার ইচ্ছায় আমার বিয়ে হয়, তখন থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে পান-সিগারেট, চা-বিস্কুট বিক্রি করি।
 
আব্দুল জলিল বলেন, তার বয়স এখন ৩৪ বছর। ময়মনসিংহের হালুয়ারঘাট উপজেলার জলজলিয়া গ্রামে তার বাড়ি। বাবার নাম আকবর আলী। মা-বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক বছর পর তারা মারা যান।  
 
চার সন্তানের জনক আব্দুল জলিল কমলাপুর রেলস্টেশনে এখনো হকার। স্টেশনের এদিক-সেদিক ঘুরে চা-পান, সিগারেট বিক্রি করেন। আর গ্রামে স্ত্রী ও সন্তানদের কয়েক মাস পরপর দেখতে যান।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৫
টিএইচ/এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।