ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বিলুপ্ত এক রাজবংশের কয়েদখানা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৬
বিলুপ্ত এক রাজবংশের কয়েদখানা ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নাটোর থেকে ফিরে: কাচারি ঘরের বাইরেটাই যা দৃষ্টিতে বসে, ভেতরে দেখার কিছু নেই- মনে হচ্ছিল এমনটাই। তবু এগিয়ে যাই অন্ধকারের দিকে।

মোবাইলের টর্চ জ্বালাতেই বাদুড়ের দল আয়েস ভুলে কিচ কিচ শব্দে উড়ে গেলো।

এই ঘরে বাইরে থেকে আলো আসার কোন পথ নেই। শুধুই অন্ধকারের গহ্বরে সেঁধিয়ে যাওয়া। জেঁকে বসা সেই অন্ধকার মোবাইলের আলোয় চোখে সওয়াতেই নাকের ডগায় এক লোহার খাঁচা।   অন্ধকারের এই গুহায় মোটা লোহার গারদে আটকে রাখা হতো অপরাধীদের। বা যারা হয়তো খাজনা দিতে পারেনি আগের বছর।

রাজা আর রাজপরিবারের ইতিহাসের অন্তরালে কালো এক অধ্যায়ের স্বাক্ষীই দেয় এই জেলখানা। উঁচু দেয়ালে ঘেরা ঘরটি মোবাইলের আলোতে দেখতে থাকি। দৈর্ঘ্যে খাঁচাটি ১৬ ফুট হবে, প্রস্থে ১২ ফুট, আর লম্বায় ১০ ফুটের মতো। বর্তমানের এই সময় থেকে রাজার যুগের জেলখানা যে কষ্টদায়ক ছিল তা এই খাঁচাই প্রমাণ করে। যেখানে নেই আলো-বাতাস প্রবেশের পথও। ইন্টারনেট জগতে নাটোরের রাজবাড়ির এমন কোন ইতিহাস লেখা হয়নি। কারণ ইতিহাস শুধু রাজা আর জমিদারদের জয়ের কথাই বলে গেছে।

স্যাঁতস্যাঁতে লাল দেয়ালের প্রাচীন স্থাপত্যে যেন শত বছর আগের প্রাণগুলো দৌড়ে বেড়ায়। পাহারাদার, চাপরাশি, সৈন্যদের কোলাহলে জমজমাট রাজবাড়ি। পুকুরের ধারের বাগানগুলোতে ব্যস্ত মালি। মন্দিরের ঢং ঢং শব্দে পূজা চলছে। এসবই শত শতাব্দীর ইতিহাস।

এক দাপটশালী রাজবংশের বিচরণ ছিল এ প্রান্তরে। সেখানে এখনো ঘাট বাঁধানো পুকুর, আস্তাবল, চৌকিদারদের বাসভবন, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিখা, মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি সবই রয়েছে। তবে জীর্ণ-শীর্ণ। আর দাপুটে রাজত্ব ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
 
নাটোর শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নাটোরের রাজবাড়ি। ১০ টাকার টিকেট কেটে ঢুকলেই লম্বা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে ইতিহাসের প্রান্তরে। প্রথমেই হাতের ডানে পড়ে জল টুংগি পুকুর। এখন চারদিকে সীমানা দেয়া এ পুকুরে রয়েছে একটি ঘাট।

এরপর হাতের বামে অপূর্ব স্থাপত্য শৈলীর নির্দশন তারকেশ্বর শিব মন্দির। এখানে শিব আর কৃষ্ণের মূর্তি ছাড়াও রয়েছে তিন মাথা ও পাঁচ মাথা বিশিষ্ট কাল নাগিনী প্রতীমা। এই মন্দিরে বিশেষভাবে নাগিনীর দাপট দেখা যায়।
 
রাজবাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি অষ্টাদশ শতকের শুরুতে। ১৭০৬ সালে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানী চরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরিচ্যুত হন। দেওয়ান রঘুনন্দন জমিদারিটি তার ভাই রাম জীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এভাবে নাটোর রাজবংশের পত্তন হয়। বাংলানিউজ হেঁটে বেড়ায় রাজবংশের ইতিহাসে।

মন্দির থেকে বেরুলেই রাজবাড়ির একটি ভবন। বড় ফটক দরজা। কাঠের জানালাগুলো ভেঙ্গে গেছে অনেক জায়গায়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে।

ইতিহাস বলে, রাজা রাম জীবন নাটোর রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ সালে, মতান্তরে ১৭১০ সালে। ১৭৩৪ সালে তিনি মারা যান। ১৭৩০ সালে রাণী ভবানীর সাথে রাজা রাম জীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের বিয়ে হয়। রাজা রাম জীবনের মৃত্যুর পরে রামকান্ত নাটোরের রাজা হন।
 
সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপনা বলতে শ্যাম সুন্দর মন্দির। কেন্দ্রীয় ভবনের সামনের মাঠের পূর্ব পার্শ্বে এই মন্দিরের পাশেই গার্ডদের রুম ছিল। শত শত পাইক পেয়াদায় গম গম করতো এই চত্বর এবং আশপাশ।

১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
 
বিশাল জমিদারির রাজধানী নিজ জন্মভূমিতে স্থাপনের জন্যে রঘুনন্দন, রাম জীবন ও পণ্ডিতবর্গ তৎকালীন ভাতঝাড়ার বিলকে নির্বাচন করেন। ভাতঝাড়ার বিল ছিল পুঠিয়া রাজা দর্পনারায়ণের সম্পত্তি। এজন্য রঘুনন্দন ও রামজীবন রাজা দর্পনারায়ণের নিকটে বিলটি রায়তী স্বত্বে পত্তনীর আবেদন করেন। নতুন রাজাকে রাজা দর্পনারায়ণ জমিটি ব্রহ্মোত্তোর দান করেন। রামজীবন বিলে দীঘি, পুকুর ও চৌকি খনন করে সমতল করেন এবং রাজবাড়ি স্থাপন করেন। এলাকাটির নামকরণ করেন নাট্যপুর। ১৭০৬-১৭১০ সালে নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল। রঘুনন্দন বড় নগরে(মুর্শিদাবাদে) থাকতেন।

মাঠের প্রান্তের ভবনের দরবার ঘরে যাওয়া যায়। তিনতলা উচুঁ দরবার ঘরের দেয়াল আর ছাদে রাজবাড়ির ঐর্শ্বর্য আর গৌরবময় ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়। কাঠের ভারী ভিম দিয়ে বানানো হয়েছে ছাদ। আর ভবনের সামনে উচুঁ স্তম্ভ যেনো এখনো দাপটে দাঁড়িয়ে আছে।
 
তার পাড় ধরে এগুলেই দেখা মেলে রানী ভবানীর মহলের। হয়তো শতবছরের স্থাপনাগুলো এখন অনেকটাই মাটিতে গেঁথে গেছে। তাই দরজা জানালাগুলো এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। লাল শ্যাওলা ধরা ইঁটে ইঁটে গেঁথে আছে রানী ভবানীর কৃত্তি। তবে এরপরের কিছু স্থাপনাতে এখনো বাস করছে মানুষ। বোঝা যায়, এই ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের অবস্থা যে বেশি ভাল নয়।

রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। ছোট-বড় ৮টি ভবন আছে। ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। রাজবাড়ি বেষ্টন করে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। পুরো এলাকা ২টি অংশে বিভক্ত, ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হল শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির।
 
১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি রানী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান বা যুবপার্ক হিসেবে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৬
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।