ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘ক্যান-পার্টি’ উৎখাত, আছে ‘স্ট্রাইক টিম’

বোটানিক্যালে নেই নিরাপত্তা শঙ্কা, ঘুরে আসুন

বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে রাইসুল ইসলাম, ছবিতে জিএম মুজিবুর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৬
বোটানিক্যালে নেই নিরাপত্তা শঙ্কা, ঘুরে আসুন ছবি: জি এম মুজিবর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: সন্তানদের নিয়ে যে বাবা-মায়েরা কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যে শিক্ষকরা রাজধানীর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (বোটানিক্যাল গার্ডেন) ঘুরিয়ে আনতে চান তাদের জন্য সুখবর। বোটানিক্যালে নেই কোনও ‘ক্যান-পার্টি’, দালাল-চক্রের ত্রাসের রাজত্বও আর নেই।

আর তাতে কেটেছে রাজধানীর ভেতরে এই সবুজ উদ্যানের নিরাপত্তা বিষয়ক শঙ্কা।

প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশক পার করে এই উদ্যান সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই কুঁড়িয়েছে। এক সময় উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষার অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠলেও, প্রকৃতিপ্রেমিদের পছন্দের স্থান হলেও পরে এই গার্ডেনে বড় হয়ে দেখা দেয় অসামাজিক কিছু কর্মকাণ্ড, আর সন্ত্রাস, সহিংসতাও। এতে ধীরে ধীরে জৌলুস হারাতে থাকে বোটানিক্যাল গার্ডেন।

দিন কয়েক আগেও বোটানিক্যালে বেড়াতে যাওয়াটা ছিলো দর্শনার্থীদের জন্য এক ভীতিকর অভিজ্ঞতার আরেক নাম। স্থানীয় বখাটে চক্র, হকার নামধারী এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের অসাধু কর্মচারীদের সিন্ডিকেটে গঠিত ক্যান-পার্টির আর হাতে জিম্মি থাকতে হতো দর্শনার্থীদের। আর ‘ ডেটিং স্পট’ পরিচালনাকারী মাস্তান চক্রের অবাধ রাজত্ব ছিলো এই বোটানিক্যাল গার্ডেন।  

সুখবর হচ্ছে- এসব মাস্তান চক্র উৎখাত করা হয়েছে। ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এই গার্ডেনের অসাধু কর্মচারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। তাতে বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে উঠেছে দর্শনার্থীদের জন্য নিরাপদ।

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) গোটা দিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে সরেজমিন কাটিয়ে এসব তথ্য জানা যায়। আর তার বাস্তবতাও নিশ্চিত হয় বাংলানিউজ।  
 
কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তারক্ষীরা জানালেন, ‘ক্যান পার্টি’ নামে পরিচিত ভ্রাম্যমাণ হকাররাই ছিলো বোটানিক্যালে দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বড় উৎপাত। না চাইলেও জোর করে দর্শনার্থীদের হাতে গছিয়ে দেয়া হতো পানি কিংবা কোমল পানীয়ের বোতল। আদায় করা হতো তিন গুণেরও বেশি দাম। না দিতে চাইলে চলতো শাসানি কিংবা মারধর। এমনকি টাকা পয়সা ও সঙ্গের মূল্যবান অন্যান্য জিনিসও রেখে দেয়া হতো। আর সাথে নারী কেউ থাকলে তো কথাই নেই। অশালীন আচরণের সঙ্গে এমনকি গায়ে হাত দিয়ে তাদের লাঞ্ছিত করতেও কুণ্ঠিত হতো না এসব দুর্বৃত্ত।

ছিলো ‘ ডেটিং স্পট’ পরিচালনাকারী মাস্তান চক্রের অবাধ রাজত্ব। টাকার বিনিময়ে উদ্যানের বিভিন্ন ঝোপের আড়ালে অসামাজিক কাজের সুযোগ করে দিতো তারা। পাশাপাশি নিছক ঘুরতে আসা নিরীহ নারী-পুরুষদেরও জিম্মি করে আদায় করা হতো অর্থ। এদের ত্রাসে বোটানিক্যাল গার্ডেন পরিণত হয়েছিলো অসামাজিক যত কর্মকাণ্ডের অভয়ারণ্যে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবার পরিজন ও শিশুদের নিয়ে পারতপক্ষে ভদ্রলোকরা এড়িয়ে চলতেন রাজধানীর সবচেয়ে সবুজ ছায়াময় সাজানো গোছানো এই প্রাঙ্গণটিকে।

দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ এমনটাই জানালেন উদ্যানের পরিচালক মো. ছায়ীদুর রহমান।
 
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উদ্যান পরিদর্শনের অনুমোদিত সময়ের মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উদ্যান কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর এমনটাই জানালেন তিনি।

নিরাপত্তা নিয়ে আর শঙ্কা নেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এখন আর চোখে পড়বে না ক্যান পার্টি নামধারী দুর্বৃত্তদের। ভেতরে হকার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমনকি বেশি দাম রাখার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভেতরে থাকা অনুমোদিত তিনটি ফুড কর্নারও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরের খাবারের দোকানগুলোতেও এখন আর নেই  গলাকাটা দাম নেওয়ার সুযোগ।

দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে সদা তৎপর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ইজারাদারদের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীসহ উদ্যানের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষীরা। সরেজমিনে ঘুরতে গিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের এই বদলে যাওয়া দৃশ্যপটই চোখে পড়লো সবচেয়ে বেশি করে।
 
বাগানের পুরনো কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই দিন বদলের মূল কারিগর হলেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের বর্তমান পরিচালক মো. ছায়ীদুর রহমান। মূলত তিনি যোগ দেয়ার পর থেকেই উন্নত হতে থাকে বাগানের পরিবেশ। স্থানীয় মাস্তান চক্র ও ‘ক্যান পার্টি’কে বাগান থেকে উচ্ছেদে তিনি শুরু থেকেই নিয়েছেন শক্ত ভূমিকা।  

একটি দেশের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান হিসেবে বোটানিক্যাল গার্ডেনে এখনও অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধার খামতি থাকলেও অন্তত উদ্যানে ঘোরার সময় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে যে আপাতত দুশ্চিন্তা নেই, তা বেশ জোরের সঙ্গেই জানালেন পরিচালক সাইদুর রহমান।
 
যোগ দিয়েই এই ‘ক্যান পার্টি’, হকার ও মাস্তান চক্র হটাতে পদক্ষেপ নেন তিনি।   জানালেন, ‘ভেতরে যত সৌন্দর্যই থাক না কেন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকলে উদ্যান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন দর্শনার্থীরা’।

কিছুদিন আগেও মাঝে মাঝেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে লাশ পাওয়া যাওয়ার কথা শোনা গেলেও এখন সে সব বন্ধ হয়েছে বলেও জানান ছায়ীদুর রহমান।
 
এজন্য তিনি কৃতিত্ব দিলেন উদ্যানের প্রবেশমুখের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ‘ অ্যাডোনাইজ’কেও। বাগানের নিরাপত্তা রক্ষীদের পাশাপাশি ইজারাদার প্রতিষ্ঠানও বেতনভুক্ত নিরাপত্তা রক্ষী দিয়ে উদ্যানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে উদ্যান পরিদর্শনের সময় নারী শিশুসহ দর্শনার্থীদের আর যাই হোক নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয়ে পড়তে হবে না বলে আশ্বস্ত করলেন তিনি।  

সারাদিন বিশাল এই উদ্যানের বিভিন্ন স্থান ঘুরেও কোনো হকার চোখে পড়লো না। উদ্যানের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষীদের পাশাপাশি অ্যাডোনাইজের নিযুক্ত নেভিব্লু  ইউনিফর্মধারী নিরাপত্তা রক্ষীদেরও দেখা গেল।
 
এ ব্যাপারে উদ্যানের প্রবেশ পথে কথা হয় ‍অ্যাডোনাইজের সুপারভাইজার আরিফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আগের ইজারাদারদের অনেক বদনাম থাকলেও  প্রবেশমুখের ইজারার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই উদ্যানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে ‘অ্যাডোনাইজ’।

তিনি জানালেন, নিরাপত্তা নিয়ে এখন আর শঙ্কা না থাকলেও আগের বদনামের কারণে এখনও উদ্যানে ঘুরতে আসতে ভয় ‍পান সাধারণ দর্শনার্থীরা। বিশেষ করে নারী-শিশু ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাধারণ দর্শনার্থীরা তেমন আসছেন না। শুক্রবার ও অন্যান্য ছুটির দিন সর্বোচ্চ হাজার চারেক টিকিট বিক্রি হয় তাদের। আর অন্যান্য দিন মেরে কেটে এক হাজার টিকিটও বিক্রি করা সম্ভব হয় না। টিকিট বিক্রি বাড়াতে তারা নিজেরাই উদ্যানে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ দিয়েছেন। বাড়তি নিরাপত্তা দিতে তাদের রয়েছে ‘স্ট্রাইক টিম’। অর্থাৎ কোনো দর্শনার্থী উদ্যানের ভেতরে নিরাপত্তা জনিত সমস্যায় পড়লে টিকিটে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে ফোন দিলেই তার কাছে ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে অ্যাডোনাইজের ‘স্ট্রাইক টিম’।
 
উদ্যানের নিরাপত্তা নিয়ে যে শঙ্কা আর নেই সে ব্যাপারটি মিডিয়ায় তুলে ধরার জন্যও অনুরোধ জানালেন তিনি।

আসলে নগরীর কোলাহল ছেড়ে অন্তত একদিনের জন্য কেউ যদি লীন হতে চান প্রকৃতির সঙ্গে, তবে রাজধানী ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই ।
 
বোটানিক্যাল গার্ডেনেই মজুদ রয়েছে সবুজ পিয়াসী মনের সব ধরনের খোরাক। প্রকৃতি প্রেমিকরা এখানে উপভোগ করতে পারেন উদ্যানের সবুজ ছায়াময় পরিবেশ। শিশুদের নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে পারেন উদ্যানের সাজানো গোছানো ঘাসের চত্বরে। তাদের চেনাতে পারেন, গাছ, লতাপাতা, গুল্ম।

২০৮ একরের এই বিশাল উদ্যানে রয়েছে লেক, কৃত্রিম দ্বীপ, দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গোলাপ ও মৌসুমী ফুলের একাধিক বাগান, ক্যাকটাস-অর্কিডের গ্রিন হাউজ, এমনকি রয়েছে জলপ্রপাতও। এছাড়া রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, লেকের সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য পর্যবেক্ষণ ডেক। পদ্ম পুকুর, শাপলা পুকুর, আর দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বাঁশ, বেত আর পাম গাছের বাগান।

এসব নিয়ে বিস্তারিত থাকছে পরবর্তী প্রতিবেদনে।  

প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে বোটানিক্যাল গার্ডেন ( জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান)। প্রবেশ মূল্য মাত্র দশ টাকা। তবে দুই বছরের নিচের শিশুদের জন্য ফ্রি। এছাড়া শিক্ষা সফরের আসা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাড়। এক্ষেত্রে অবশ্য আগেই যোগাযোগ করে নিতে হবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।