ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

সুরসুরির কনটেন্ট ও অনলাইন সাংবাদিকতার দায়!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৬
সুরসুরির কনটেন্ট ও অনলাইন সাংবাদিকতার দায়!

বছর কয়েক আগের কথা। তখন বাংলাভাষায় অনলাইনে ‘চটি’র প্রাধান্য ছিলো।

সার্চইঞ্জিনে বাংলায় কোনও শব্দ লিখে খুঁজলে ওইসব কনটেন্ট সামনে চলে আসতো।

২০০৪ সালে দেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক সাংবাদিকতা চর্চার শুরু। আর তারও কিছু আগে থেকে দুই-একটি দৈনিক সংবাদপত্র তাদের ছাপা পত্রিকার কিছু কিছু অংশ অনলাইনেও প্রকাশ করতো।

২০১০ সালের মাঝামাঝিতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এসে অনলাইনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করে। আর তার অন্যতম দিকটি হচ্ছে প্রতিদিন তিন শতাধিক নিউজ আইটেম প্রকাশ। গড়ে প্রায় দেড় লাখ বাংলা শব্দ অনলাইনে ছাড়া।

সেই হিসেবে গত প্রায় ছয় বছরে কেবল বাংলানিউজই অনলাইনে ছেড়েছে ৩০ কোটি ৬০ লাখ সংবাদ-বিনোদনভিত্তিক বাংলা শব্দ। আর পাশাপাশি ইংরেজি ভার্সন থেকেও প্রকাশিত হয়েছে আরও প্রায় ১০ কোটি শব্দ। তবে ইংরেজি নয়, প্রসঙ্গ বাংলাশব্দ, বাংলা কনটেন্ট নিয়ে। দাবির সঙ্গে বলা যায় এই কোটি কোটি সংবাদভিত্তিক শব্দ যখন ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়লো তখন কিছুটা হলেও ঢাকা পড়লো ওই সব নোংরা কনটেন্ট।

এরই মধ্যে বের হতে শুরু করলো আরও কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যম। সংবাদপত্রগুলোও তাদের পত্রিকা অনলাইনে প্রকাশ করতে শুরু করলো। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষায় অনলাইন কনটেন্ট সম্মৃদ্ধ হতে থাকে।

কিন্তু ইদানিং এ কীসব লক্ষ্য করছি! ভার্চুয়াল জগতে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যানভাসে একটু স্ক্রল ডাউন করলেই দেখা যাবে বিভিন্ন অনলাইনের লিংক। নাম থেকে ধরে নিতে হবে এগুলো সংবাদভিত্তিক অনলাইন। কিন্তু তার যে কনটেন্ট, উপস্থাপনা ভঙ্গি, শিরোনাম সব কিছুই সেই ‘চটি’সম।

এগুলো কে লেখে? কারা লেখে? সেদিকটা খুঁজতে গেলে হয়রাণ হতে হবে। কারণ লেখকের নাম থাকে না। কিভাবেই থাকবে? যা কিছু লেখা হয় তার সঙ্গে অনেকেই নিজের নামটা জুড়তে চাইবে না। কিন্তু ওইসব অনলাইন খুব সহজেই হাতের কাছে মেলে। লাইক আর শেয়ারিংয়ের ঝড় বয়ে যায়।

তাতে বলা চলে অনলাইনের যে পাঠককুল, তারাও বুঝি পছন্দই করে এসব। তা-না হলে এত লাইক-রিঅ্যাক্ট আর শেয়ারিং কেনো?

কিন্তু পাঠক সৃষ্টি করাও কিন্তু সংবাদমাধ্যমের একটা দায়িত্ব। পাঠকের কাছে সংবাদ-বিনোদনের কনটেন্ট যত বেশি বেশি দেওয়া যাবে ততই তারা এসব নোংরা কনটেন্টের দিকে কম যাবে।

কিন্তু সেটা হচ্ছে কই? বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ছয় বছরে যে সাড়ে ৩০ কোটি শব্দ উৎপাদন করেছে তা এই ভার্চুয়াল জগতে বর্তমানে বিরাজিত শব্দ ভাণ্ডারের তুলনায় সামান্য বৈকি।

পক্ষান্তরে নোংরা কনটেন্টগুলো তৈরির মতো অনলাইন মাধ্যমের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন কয়েক শ’ করে নতুন নতুন অনলাইন তৈরি হচ্ছে। নিউজ আর বাংলাদেশকে সমন্বিত করে একটি নতুন ডমেইন নামও আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই নিউজ শব্দটিকে ব্যবহার করছে আর তাতে আজেবাজে কনটেন্ট আপলোড করছে। এগুলো আবার জ্যামিতিক হারে ভাইরাল হচ্ছে।

কারণ একটি মাধ্যমে কোনও একটি লেখা প্রকাশিত হলে নিমিষে তা আরও ডজন ডজন অনলাইনে প্রকাশিত হয়ে যায়। রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়ার তালে তারা আবার ফেসবুকে তার পোস্ট দেয়। কেউ কেউ পয়সা খরচ করে বুস্টও করে। ফলে সার্চইঞ্জিন চলে যায় এদের দখলে।

সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইদানিং কিছু মেইনস্ট্রিম সংবাদপত্র এই দিকে ঝুকেছে। এদের নামের শেষাংশ ঠিক রেখে আগের অংশে ‘চটি’ শব্দ যোগ করে সমালোচনাও হচ্ছে। কিন্তু সস্তায় বা সহজে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে তারা অনলাইনে সেই সব ছাড়ছে যা আবার তাদের মূল পত্রিকায় থাকে না। কারণ, তারা জানে মূল পত্রিকায় এসব কনটেন্ট তাদের নিন্দিত করবে, পাঠক চটে যাবে। কিন্তু চটবে না তাদের অনলাইন ভার্সনের পাঠক তাই সেখানে চটিসম লেখালেখি খুব ছাপছে। এ যেনো অনলাইনে সবই যায়েজ!

স্পষ্ট করে বলতে চাই, এতে অনলাইনের পাঠককেই ছোট করা হয়। তাদের গুরুত্বহীন করে ভাবা হয়। বাংলানিউজসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যম যে বিশাল অনলাইন পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করেছে, তারা অনলাইনে প্রতিদিনকার খবর যেমন দেখতে চান, তেমনি বিনোদনও তারা পেতে চান অনলাইনেই। সংবাদপত্র পাঠে অসুবিধা আর অনভ্যাসের কারণেই তারা অনলাইনে ঝুঁকছেন। কিন্তু তারা অনলাইনেও তাই চান যা তারা একসময় সংবাদপত্রে পড়েছেন। এটা নয় যে কেবল অনলাইনে তারা নোংরামি খোঁজে!

অনলাইনের পাঠককে ছোট করে দেখা এই পত্রিকাগুলোর মধ্যে দেশের প্রধানসারিরগুলোও রয়েছে। প্রতিদিনই কয়েকটি উদাহরণ এসব সংবাদপত্র তৈরি করছে যাতে দেখা যাবে, তারা লাইক আর শেয়ারিংয়ের ধান্ধায় অনলাইনে এমন কিছু প্রকাশ করছে যা তাদের মূল সংবাদপত্রে নেই। এটা লজ্জাকর। অনলাইন এদের বাই-প্রোডাক্ট।

‘সেক্স-মানি-ক্রাইম, দ্যাট ইজ নিউজ’ এটা সংবাদের সংজ্ঞা। সুতরাং সংবাদে সংবাদমাধ্যমে সেক্স বা যৌনতার বিষয়টি খবরের উপাদান হিসেবেই থাকবে। সে উপস্থাপনাও স্রেফ পাঠকের প্রয়োজনেই। কিন্তু সেটা যেনো কোনওভাবেই নোংরামির পর্যায়ে না যায়। আর তার উপস্থাপনাতেও যেনো থেকে যায় শিল্পের প্রকাশ, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।

সুতরাং সুরসুরিমূলক কনটেন্ট নয়, সংবাদ আর বিনোদনের মানানসই কনটেন্ট দিয়েই অনলাইনকে ভরে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, যোগ্য পাঠক তৈরি হচ্ছে আর দিন দিন তার সংখ্যা বাড়ছে। ফলে একদিন এমন সংবাদমাধ্যমকে তারা ছুঁড়ে ফেলবেই।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।