অনেকের মতে, মতিঝিল ছিলো ভাগীরথী নদীর একটি সর্পিল বাঁকা গতিপথ। আবার অনেকে মনে করেন, নবাব আলীবর্দীর সময় মুর্শিদাবাদে বহু অট্রালিকা প্রস্তুত করার জন্য ইটের জন্য যে মাটি তোলা হয়েছিল সেই খাদগুলোই মতিঝিলে পরিণত হয়েছে।
মতিঝিলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলীবর্দীর জামাতা মহম্মদ নওয়াজেস আলি খাঁন এই ঝিলের তীরে নিজ স্ত্রী মেহেরুন্নেসার জন্য একটি অপূর্ব প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। মতিঝিলের ওই প্রাসাদের নাম ছিলো ‘সাঙ্গ-ই-দালান’ বা পাথরের প্রাসাদ। পাথর দিয়ে তৈরি ছিলো মেহেরুন্নেসার প্রাসাদ। এখানে শুধু প্রাসাদই নয়, ছিলো তোরণ ও মসজিদ, বাগান, ধনভাণ্ডারসহ আরও অনেক কিছু!
মতিঝিল মূলত একটি অশ্বখুরাকৃতির হৃদ। পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে শুরু করে ইউটার্ন নিয়ে আবার কাছাকাছি পশ্চিম প্রান্তেই শেষ হয়েছে। পশ্চিম পাশের একপ্রান্তে আছে মসজিদ ও সমাধিক্ষেত্র। আর মধ্যখানে বিশাল বাগান ও হ্রদের শেষপ্রান্তেই (পূর্বদিকে) ছিলো ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। সেই প্রাসাদ আজ আর নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে অনেক আগেই।
এখানে যে মসজিদটি রয়েছে তা কালা মসজিদ নামে আখ্যা লাভ করেছে। কেন এই নাম তা জানা যায় না। মসজিদটি আকারে খুব বড় নয়। মসজিদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে, চারপাশে রয়েছে চারটি মিনার।
মসজিদের পূর্বদিকেই রয়েছে একটি ছোট সমাধিক্ষেত্র। এখানে রয়েছে ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজেস আলি খাঁন, তার পালক পুত্র একরামউদ্দৌলা (সিরাজ-উদ-দৌলার ভাই) এবং একরামের শিক্ষক ও নওয়াজেস খাঁনের সেনাপতির কবর। পাশে রয়েছে একরামের এক সেবিকার একটি আলাদা কবরও।
মসজিদের বাইরে একটি উঁচু রাজকীয় তোরণ এখনও রয়েছে তবে তা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই মসজিদে একটি পবিত্র কুরআন সংরক্ষিত আছে এবং যা নওয়াজেস খাঁন নিজের হাতে লিখেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
সিরাজের ভাই নওয়াজেসের পালকপুত্র একরামউদদৌলার মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (১৭৫৫ সালে)। পালকপুত্রের পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
মতিঝিলে একটি জানালা দরজাহীন প্রকোষ্ঠ বা দেয়াল রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ২০ মিটার, প্রস্থ ৬.৫ মিটার ও উচ্চতা ২.৪০ মিটার। এটি নিয়ে অনেক রহস্য আছে। অনেকে মনে করেন এটি ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার আবার অনেকে বলেন সিরাজ মতিঝিলে আক্রমণ করে যখন ঘসেটি বেগমকে হীরাঝিলে নিয়ে যান, তখন তার সহচরীদের এখানে কবর দিয়ে চারদিকে দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেন। কিন্তু এটি সিরাজ সম্পর্কে একটি বিকৃত ইতিহাসেরই নজির। এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে এর রহস্যভেদ আজও হয়নি।
তবে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটে বলা হয়েছে, একজন ইংরেজ ঔৎসুক্যবশত: কয়েকজন মজুর নিয়ে ওই প্রকোষ্ঠ বা দেয়ালটি ভাঙতে আরম্ভ করলে কয়েকজন শ্রমিক রক্তবমি করে মৃত্যুবরণ করেন এবং এর কয়েকদিন পরে ওই ব্রিটিশ সাহেবও আত্মহত্মা করেন। এর পর প্রকোষ্টটিতে আর কেউ হাত দেয়নি। আজ অবধি সেভাবেই রয়েছে। আজও কথিত সেই ধনভাণ্ডার বা রহস্য প্রকোষ্ঠের রহস্যভেদ হয়নি। হয়তো হবেও না কোনো দিন!
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন:
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার
** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব