ভারতবর্ষের সমুদ্র উপকূলে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি ঘুরঘুর করেছে। মাদ্রাজ, বাংলা দিয়ে সম্পদশালী উপমহাদেশের মাটিতে স্থান পাওয়ার জায়গা খুঁজছিল তারা।
বাংলায় অনুপ্রবেশে আগ্রহী আদি ঔপনিবেশিক শক্তি ওলন্দাজরা সযতনে কলকাতাকে এড়িয়ে কুঠি ফেঁদেছিল কিঞ্চিত দূরে, হুগলীর চুঁচুড়ায়। ওলন্দাজদের কেউ কেউ নাকি কলকাতাকে ডাকত ‘গলগথা’ নামে, যার মানে মড়ার খুলি, বা খুলিভর্তি জায়গা। মনে রাখতে হবে, যিশুকে যেখানে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই পাহাড়ের নামও ছিল ‘গলগথা’। সেই প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, মহা দুর্দশার জায়গা বোঝাতে এই কথাটা ব্যবহার করা হয়।
শুধু ওলন্দাজদের দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। কারণ, ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যাচ্ছে, ‘বঙ্গদেশ মুঘল ও অন্যান্য বৈদেশিকগণের স্বাস্থ্যের প্রতিকূলরূপে বিবেচিত হইত; সেই জন্য যে সকল কর্মচারী রাজার বিরাগভাজন হইত, তাহারাই বঙ্গদেশে প্রেরিত হইত। সুতরাং এই উর্বর ভূখণ্ডে চিরবসন্ত বিরাজমান থাকিলেও, ইহা অন্ধকারময় কারাগার, প্রেতভূমি, ব্যাধিনিকেতন ও যমালয় স্বরূপে পরিগণিত হইত। ’
এহেন বাংলায় তথা কলকাতায় দুর্ধর্ষ ইংরেজরা এসে ঘাঁটি বানালেন। যদিও তারা জানতেন, ইংরেজদের মধ্যে প্রচলিত ‘টু মনসুন্স’ কথাটা। এর মানে, নতুন সাহেব ও মেম জাহাজ থেকে নেমে কলকাতার চন্দ্রপাল (চাঁদপাল) ঘাটে পা রাখার পরে তাঁদের আয়ুর সীমাকাল মাত্র দুটি বর্ষা। এর মধ্যেই কবরের মাটিতে আশ্রয় নিত অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ। সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ইংরেজ ছেলেছোকরারা আসত চটজলদি টাকা কামানোর ধান্দায়; শ্বেতাঙ্গিনী যুবতী মেয়েরা আসত বড়লোক স্বামীর খোঁজে। তারা অনেকেই গিয়ে মিলত গোরস্থানে। তবু তারা ঝুঁকি নিয়ে কলকাতা তথা বাংলায় এসেছে উন্নত জীবনের সন্ধানে।
শুধু সাহেবরা নয়, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, যেসব পশ্চিমি সেপাই কোম্পানির বাহিনীতে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসত, দো-আঁশলা ভাষায় আক্ষেপ করত তারা এই বলে:
“দাদ হোয়, খাজ হোয়,
আর হয় হৌহা
কলকাত্তা নাই যাও
খাও মৌহা। ”
তা সত্ত্বেও, তখন কলকাতা ছিল দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কালক্রমে রাজধানী। ফলে, মৌহা না খেয়ে তারা বরং কলকাতাতেই আসত। বিরাম ছিল না লোক আসার। বিরাম ছিল না রোগের, মৃত্যুরও। আর বিরাম ছিল না নানা বিপদের মোকাবেলা করে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার। ইউরোপের কাছে বাংলা তথা ভারত ছিল স্বপ্নের দেশ; দ্রুত ধনবান হওয়ার উর্বর জনপদ। অতএব, বাংলায় বসবাস ও প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে তারা পিছ পা হয় নি।
এমনই এক সুযোগ ও সম্ভাবনার শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জোব চার্নক (১৬৩০-১৬৯২)। সেটা ১৬৯০ সালের কথা। পলাশীর প্রায় শতবর্ষ আগের ঘটনা সেটি। যদিও চার্নক এসেছেন ১৬৯০ সালে, তথাপি ইংরেজরা বাংলায় আসে আরও কিছুদিন আগে।
ইতিহাসের ভাষ্য মতে, ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রানি প্রথম এলিজাবেথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেন। ১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায় কোম্পানি। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসাবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মাধ্যমে বাংলায় ইংরেজ আগমনের সূচনা ঘটে। সেই সূত্রকে ব্যাপক রূপ দেন কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা জোব চার্নক। একই বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাসিমবাজার কারখানায় জোব চার্নক একজন নিম্নপদস্থ ব্যবসায়ী হিসাবে যোগদান করেন এবং বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ের কাজে ঘুরতে থাকেন। এবং কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তিনিও বাংলার শাসনকর্তা কর্তৃক বিতাড়িতও হন। তথাপি হাল ছাড়েন নি এই ইংরেজ ভদ্রলোক। বাংলায় স্থায়ী জায়গা পাওয়ার চেষ্টায় লেগেই থাকেন এবং এক পর্যায়ে সফলও হন।
সুযোগ আসে তখনই, যখন মুঘল-বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের উত্তরাধিকারী সুবেদার ইবরাহিম খান বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরায় শুরু করতে ইংরেজদের ডেকে পাঠান। দু’টি প্রধান বিষয়ে আলোচনা করতে কৌশলী চার্নক সুবেদারের মুখোমুখি হন। প্রথমত, ইংরেজদের বসতি হুগলি থেকে সুতানুটিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবে সরকারকে রাজি করানো। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক পূর্বনির্দিষ্ট ৩০০০ টাকা কর পরিশোধের বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি প্রদানকারী একটি ফরমান দ্বারা সুবাদারের আনকূল্য আদায় করা। সুবাদার ইবরাহিম খান উভয় প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত হন।
১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জোব চার্নক হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত জলাভূমি বেষ্টিত সুতানুটির নির্বাচিত জমিতে ইংরেজের পতাকা উত্তোলন করেন, যা পরবর্তীকালে কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর মিলে ব্রিটিশ উপনিবেশের রাজধানী কলকাতা নগর হিসাবে গড়ে ওঠে। জোব চার্নকের কাজগুলোকে আপাত দৃষ্টিতে সরল ও কেবল বাণিজ্যিক কার্যক্রম বলে মনে হলেও সেগুলো ছিল সুদরপ্রসারী। নিঃশব্দে অনুপ্রবেশ করে সকলের অগোচরে দীর্ঘমেয়াদে ইংরেজদের জন্য সামরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিই স্থাপন করেছিলেন তিনি।
ঔপনিবেশিকতাবাদের ইতিহাসের পাতা থেকে ইংরেজদের আগমনের কথা এবং চার্নকের অবদানের বিবরণ কখনো মুছে যাবে না। কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই বণিক মাদ্রাজের কর্তাদের সঙ্গে লড়াই করে কলকাতার ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদ্রাজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চেয়েছিল চট্টগ্রামে কুঠি স্থাপন করতে। কিছু খোঁজ-খবর এবং অনুসন্ধানও হয়েছিল এ লক্ষ্যে। চট্টগ্রামে কোম্পানির ঘাঁটি হলে উপমহাদেশের ইতিহাস হয়ত অন্য রকম হতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি চার্নকের জন্য। প্রায় জোর-জবরদস্তি করে তিনি কলকাতায় কোম্পানির অফিস-দুর্গ স্থাপনে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন এবং নিজে হাজির হয়ে তিনটি গ্রাম কিনে নব্য আস্তানার নাম দেন কলকাতা। স্থানীয় এক রমণীকে বিয়ে করে জব চার্নক শেষ আশ্রয় নিয়েছেন কলকাতার একটি চার্চের মাটিতেই।
চার্নক দেখলেন, ভারতের সম্পদ ভাণ্ডার বাংলার প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা। স্বাধীন সুলতানরা ঢাকার পাশে সোনারগাঁয়ে রাজধানী বানিয়ে নিজেদের শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। মুঘলরা খানিক দূরের ঢাকায় রাজধানী সরিয়ে নেন এবং নতুন শহরের নাম দেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে জাহাঙ্গীরনগর। মুঘল শক্তির এই নতুন কেন্দ্রে স্থাপিত হয় দুর্গ, সেনানিবাস ও স্থাপনা। মুঘল শক্তির অনুগত লোকজন ভিড় করে জাহাঙ্গীরনগরের চারপাশে। মুর্শিদকুলি খান মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে আধা-স্বাধীন হয়ে রাজধানী সরিয়ে নেন পশ্চিমে। পত্তন করেন মুর্শিদাবাদ নামের নতুন শহর। উদ্দেশ্য, নিজের আলাদা ও নিরাপদ শক্তি বলয় গড়ে তোলা।
চার্নক পুরো ইতিহাসটি বেশ বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন কলকাতাকে সামনে রেখে। যোগাযোগ ও অবস্থানগত কারণ ছাড়াও তিনি ইংরেজদের জন্য একটি শক্তপোক্ত ঘাঁটি বানানোর শ্রেষ্ঠ স্থান মনে করেন কলকাতাকে। কারণ, এখান থেকে ইংরেজদের আরেক কেন্দ্র মাদ্রাজের বা বিলাতের সাথে আসা-যাওয়া সহজ। রাজধানী মুর্শিদাবাদও অদূরবর্তী। রাজধানীতে থেকে ব্যবসা ও শক্তি সঞ্চয় সহজে করা সম্ভব হবে না নবাব-প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে। বরং কলকাতাকে নিজেদের ইচ্ছা মতো কাজ করার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক বিবেচনা করেন তিনি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের তার মতের পক্ষে আনতেও সমর্থ হন এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বণিক। কলকাতায় আস্তানা গেঁড়ে জোব চার্নক যে সঠিক কাজটিই করেছিলেন পরবর্তী ইতিহাস সে স্বাক্ষ্য দেয়।
প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক হলেও একে শক্তি ও ভিত্তি দেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভের বয়স তখন মাত্র পঁচিশ। এই যুবক মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য রাইটারশিপ বা কেরানিগিরি চাকরি নিয়ে ভারতের পথে জাহাজে উঠেন। সে সময় তার সামনে ছিল মাত্র দুটি উপায়: ভারতে গিয়ে ধনবান হওয়া অথবা বিলাতে হতাশায় মরে যাওয়া। তিনি প্রথম উপায়টিই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে গ্রহণ ও অনুসরণ করেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ও জাতিগত সাফল্যের স্মারকে পরিণত হয়ে ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে নিজের স্থায়ী ছাপ অঙ্কণ করেন। লর্ড মেকলের ভাষায়, ‘এদেশ (ইংল্যান্ড) অনেক বীর ও রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দিয়ে থাকলেও তার (ক্লাইভ) চেয়ে বড় যোদ্ধা এবং রাষ্ট্রনায়কের জন্ম দেয় নি। ’
কিন্তু ক্লাইভ কতটুকু যোদ্ধা আর কতটুকু ষড়যন্ত্রী ছিলেন, ইতিহাস সেটা জানাচ্ছে। এটা সত্য যে, ক্লাইভ ভারতে অনেকগুলো যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু রণাঙ্গনের সামর্থের চেয়ে বেশি তিনি ষড়যন্ত্রের চমক দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই জুন মাসে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর তথাকথিত-যুদ্ধ কিংবা ষড়যন্ত্রের ঘটনাপ্রবাহে সেসব বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের মতোই স্বাধীনতা হারানোর কথাও ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তদুপরি, পলাশীর রাজনৈতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ও ধ্বংসাত্মক। ফলে, যদিও এটি ছোট-খাট দাঙ্গার মতো একটি ঘটনা ছিল, তবু পলাশীর প্রভাব বিরাট বড় যুদ্ধের চেয়েও অধিক ছিল।
পরবর্তী পর্ব: বিদেশি বণিকের শক্তি সঞ্চয়
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৭
জেডএম/