বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধের জন্য নয়, বরং পরবর্তী-তাৎপর্য ও গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা যুদ্ধগুলোর অন্যতম মনে করেছেন। তাঁর এ মতের সঙ্গে কারো দ্বিমত পোষণের অবকাশ খুব কম।
২৩ জুন ১৭৫৭। সুবা বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের অদূরে পলাশী নামক গ্রামের প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভের সেনাবাহিনী ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে। সকাল নয়টায় যুদ্ধ শুরু, বিকেল চারটার মধ্যেই যুদ্ধ শেষ!
অতএব, এতো স্বল্প সময়ে পলাশীতে যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। যা হয়েছে, তার নাম ষড়যন্ত্র ও রাজনীতি। এহেন যুদ্ধ-নাটকের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল প্রবল পরাক্রমশালী ‘ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক কার্যক্রম’ সিরাজের স্থলে ক্লাইভকেই কেবল ক্ষমতায় আনেনি, পলাশীর ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে শুরু করে ক্রমেই সমগ্র ভারতে এবং আরো পরে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থাপন করে রাজনৈতিক-সামরিক শক্তিতে ভরপুর ‘বাণিজ্যিক বলয়’; যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে এবং আরো পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠায় ও সমৃদ্ধিতে। শুধু তাই নয়, পলাশীর প্রতিক্রিয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে “অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে। ” এভাবেই তাবৎ বিশ্ব সুদীর্ঘ বছরের জন্য ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিগুলোর শাসন ও শোষণ কবলিত হয়। অতএব, পলাশীর প্রভাব কেবল বাংলা বা ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী।
সকল সৎ, যোগ্য এবং প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক একবাক্যে বলেছেন যে, ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল ষড়যন্ত্র আর বিদ্বেষের জাল আদিতে জগৎশেঠের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই জাল বিস্তৃত হয়েছিল নানা পাত্র-মিত্রের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার পর্যন্ত মীরজাফরকে ‘দেশদ্রোহী’ কখনোই মনে করেন নি। মীরজাফরকে বেকুক ও ক্ষমতালোভী বলেছেন অনেকেই। বলেছেন, ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী। ইংরেজরা তাকে নবাব বানাবে, এমন মোটা ধারণা তার ছিল। ইংরেজরা যে পুরো দেশটিই কব্জা করে নেবে সেটা আঁচ করার মতো সূক্ষ মগজ তার ছিল না। যে কারণে শেষ দিকে ইংরেদের সাথে মীরজাফরের সম্পর্ক মোটেই মধুর থাকে নি। ইংরেজের পাঞ্জার মধ্যে অক্ষম ভাবে ছটফট করেই তার শেষ পরিণতি ঘটে।
স্বয়ং রবার্ট ক্লাইভ আসল কথাটি লিখেছেন, “কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি চক্রান্তের পেছনে থাকলেও আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল জগৎশেঠ নিজে। ” কথাটি চরম সত্য। নিজে ক্ষমতার অংশ না নিয়েও ত্যাগীর ছদ্মাবরণে ব্যবসায়িক স্বার্থে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জগৎশেঠ। সবাইকে একত্রিত করে ইংরেজের বিজয় ও সিরাজের পরাজয়ের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে মূলকেন্দ্র হয়ে কাজ করে এই জগৎশেঠ।
মঁশিয়ে জা-ল প্রমুখ সমকালীন-নিরপেক্ষ ইতিহাসকার লিখেছেন, “অনেক দিন ধরে বাংলায় যে সব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিল জগৎশেঠ। ... ইংরেজরা যা করছে (পলাশীর কথিত যুদ্ধবিজয় এবং বাংলা-ভারতে উপনিবেশ স্থাপন) তা জগৎশেঠের সমর্থন ছাড়া কখনো করতে পারত না। ”
নবাবের বিরুদ্ধে বিরূপ কিন্তু বিচ্ছিন্ন মানুষ ও শক্তিগুলোকে ভালোভাবেই চিহ্নিত করেছিল জগৎশেঠ। এদের একত্রিত করার অনুঘটকের কাজটি এবং ইংরেজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করে এই ব্যক্তি। জগৎশেঠ না হলে এতো চমৎকারভাবে ষড়যন্ত্রের মঞ্চটি নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে প্রস্তুত করা বহিরাগত ইংরেজের পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না। ভেতরের ষড়যন্ত্রকারীরাও সিরাজের ভয়ে ও নিজস্ব স্বার্থের সংরক্ষণের জন্য একাট্টা হতে পারত না। জগৎশেঠ পুরো বিষয়টিকেই চক্রান্তকারীদের জন্য সহজ করে। বাংলার আকাশে কালো অন্ধকার ঘনীভূত করতে সফলতা যদি সবচেয়ে বেশি দিতে হয়, তবে সেটা জগৎশেঠেরই প্রাপ্ত।
কে বা কারা এই জগৎশেঠ, সেটা জানা দরকার। শেঠরা বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশের লোক নয়। তারা উত্তর ভারতের যোধপুরের নাগোর এলাকার মানুষ। জৈন ধর্মের অনুসারী, হীরানন্দ তাদের পূর্ব পুরুষ। প্রথমে তারা ভাগ্যান্বেষণে বিহারের পাটনায় আসে। হীরানন্দের পুত্র মানিক চাঁদ ঢাকায় তার গদি স্থাপন করে। এ পর্যায়ে তৎকালীন শাসক মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। মুর্শিদকুলী খানের অনুগমন করে তারা নতুন শহর মুর্শিদাবাদে এসে জেঁকে বসে। বাদশাহ ফররুখ শিয়ারের কাছ থেকে তারা শেঠ উপাধি লাভ করে মুর্শিদকুলী খানেরই বদৌলতে।
ইতিমধ্যে সারা ভারতের প্রধান প্রধান নগরীতে শেঠদের গদি স্থাপিত হয় এবং চলতে থাকে অর্থলগ্নী ও সুদের ব্যবসা। বলা বাহুল্য, সে যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় জগৎশেঠরা অলিখিত ব্যাংকার হিসাবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চালাতে সচেষ্ট হয়। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হলে ভাগিনা ফতেচাঁদ প্রথম ‘জগৎশেঠ’ উপাধি প্রাপ্ত হয় এবং তার মৃত্যু হলে তদীয় পৌত্র মাহতাব চাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পায়। অপর শেঠ স্বরূপচাঁদ লাভ করে মহারাজ খেতাব। শেঠদের গদিতে তৎকালীন সময়ের বাজার মূল্যে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হত। এহেন জগৎশেঠরা পলাশী বিপর্যয়ের নেপথ্য মূল কারিগর; ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা।
মূলত নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকেই এই ষড়যন্ত্রকারীরা নানা অপকর্মে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন বটে, কিন্তু শেঠরা ঘাপটি মেরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সংহতির শিকড় কাটতে থাকে। শেঠরা নবাব পরিবারের মধ্যে অর্থ, ঘুষ ও কুমন্ত্রণা দিয়ে নানা উপদল তৈরি করে এবং একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। যে বিভক্তির চোরাপথে তারা ইংরেজদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
বিশেষ করে তরুণ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে এরা প্রথম থেকেই ছিল খাপ্পা। যে কারণে তারা সিরাজের জন্য দিল্লি থেকে সনদ আনানোর ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও গড়িমসি প্রদর্শন করে। এরা প্রথমে শওকতজঙ্গ, পরে ইয়ার লতিফ ও সর্বশেষ মীরজাফরকে বাংলার নবাব বানানোর প্রজেক্ট গ্রহণ করে। কারণ নবাব সিরাজ ছিলেন লুটেরা-শোষক শেঠদের সীমাহীন নির্যাতন, কায়েমী স্বার্থ ও নীচুতার প্রতিবন্ধক। ফলে তারা নবাব পদে সিরাজকে সহ্য করতে পারেনি এবং নিজেদের বশংবদ একজনকে নবাব বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়। এরাই পুরো ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে এবং ইংরেজ ও প্রাসাদের ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দূতিয়ালী ও সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সম্পাদিত হয় বাংলার স্বাধীনতা-বিনাশী গোপন চুক্তি। আর এভাবেই ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ-নাটকের মাধ্যমে সুদীর্ঘকালের জন্য পদদলিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
পরবর্তী পর্ব
অতঃপর যুদ্ধের নামে তামাশা
পূর্ববর্তী পর্ব
চারিদিকে চক্রান্তের বিস্তার
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৭
জেডএম/