চলমান সমাজ ব্যবস্থায় বাবাকে একটি কঠিন মুখোশ পরিয়ে রেখেছে। সেখানে আবেগের প্রকাশ করাটা যেন পুরুষের দুর্বলতা।
পুরুষের অনেকগুলো রূপের মধ্যে রয়েছে- বাবা, ছেলে, ভাই, স্বামী আরও অনেক। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে বাবা রূপটিই পুরুষকে করে তুলেছে মহান। দিয়েছে এক বাইরে থেকে এক কঠিন আবরণ।
একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন আবদুর রহিম। ৩৫ বছরের রহিম হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্পাইনাল কর্ডের ক্ষয় তাকে এক ভয়াবহ শারীরিক ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মাঝে মধ্যে কেঁদে ফেলেন রহিম। নিজের জন্যে নয়, বরং তার দেড় বছর বয়সী শিশু সন্তানের জন্যে।
এক সময় চিকিৎসকরা রহিমকে জানিয়ে দেন, তার এই রোগের ফল হিসেবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। বাসায় এসে হু-হু করে কেঁদে ওঠেন তিনি। কেন কাঁদছে? জানতে চাইলে রহিম বলেন, নিজের জন্যে নয়, আমার ছেলেটার কি হবে! আমি যদি কাজ করতে না পারি, তবে ওর ভবিষ্যৎ কি হবে! এখনো চারপাশে অনেক মানুষ, কিন্তু আমি জানি যখন অক্ষম হয়ে যাবো, হয়তো কেউই আমার সন্তানকে দেখবে না। আমি চাই না আমার সন্তান কারও দয়ায় বেড়ে উঠুক। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে বাবার। তবে সতর্ক থাকতে হয়, যেন আসন্ন বিপদের কথা কেউ বুঝতে না পারে, কারো চোখে সেই দুর্বলতা যেন ধরা না পড়ে।
শুধু বলতে থাকেন, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। সুস্থ হয়েই বেঁচে থাকতে হবে।
পুরুষের সবগুলো রূপে টানাপোড়ন শুরু হয়, যখন তিনি বাবা হন। সন্তান, ভাই বা স্বামীর তুলনায় বাবা চরিত্রে নিজেকে উজ্বল করে তোলেন। সন্তানের জন্যেই একটি জীবন উৎসর্গ হতে থাকে।
বাংলাদেশে আমাদের সংসারের আয় এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ নির্ভর। এখনো এমন পরিবারের সংখ্যাই বেশি, যেখানে পুরুষের আয়েই সংসার চলে। অন্তত দেশের বেশিরভাগ অংশ যেখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল।
ভোরে জানলার পর্দা গলে সূর্যের আলো এসে শিশু সন্তানের মুখে পড়ে। বিরক্ত শিশু কপাল কুঁচকে মিটমিট চোখে তাকায়। হয়তো চোখ খুলে দেখে হাসি মুখে পাশে বসে আছেন বাবা। কোনো বাবাই না এমন একটি দৃশ্যের জন্যে মুখিয়ে থাকে।
আমাদের তারেক ভাইকে সকালে সূর্য ওঠার সময়টায় অনেক বেশি সাবধান থাকতে হয়। জানালায় ঝোলা মোটা পর্দাগুলোকে আরেকবার পরখ করে নিতে হয়, যেন সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারে কোনো ক্রমেই। বাসায় রাখতে হয় অন্ধকারের আবহ। কারণ আলো যে তার সন্তানদের নিয়ে যায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে।
জেরোডার্মা পিগমেন্টোসাম (সংক্ষেপে এক্সপি) নামে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ১৩ বছরের শ্রাবণী জামান তূর্ণা এবং নয় বছরের মোনিম উজ্জামান খান। সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এমনকি তীব্র আলোও ভয়ংকর এই সন্তানদের জন্যে।
পৃথিবীতে এ ধরনের শিশুর সংখ্যা খু্ব বেশি নয়। চিকিৎসক জানিয়েছেন পুরোপুরি রোদ থেকে রক্ষা করতে পারলে এই শিশুরা ৪০ বছরেরও বেশি সময় বেচেঁ থাকতে পারবে। তাদের পুরো জীবনটাই সূর্যের আলো প্রতিরোধক পরিবেশে বাচঁতে হবে।
তারেকের মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। পত্রিকা অফিসগুলোতে ধর্না দেন। তার সন্তানদের নিয়ে একটু লেখার জন্যে। তার একার পক্ষে আর এতো ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এই বাবার পায়ের প্রতিটি কদম পড়ে তার সন্তানদের আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্যে।
সন্তানের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা বাবার। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চান শুধু সন্তানদের জন্যে। তিনি বলেন, আমি না থাকলে ওদের কেউ দেখবে না। আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে চায়নি। ওদের সঙ্গে কেউ খেলতে চায় না। অনেক শিশুরা ভয় পায়।
তিনি বলেন, মেয়ে বড় হচ্ছিল। বলতো, বাবা স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। আসলে ওই বয়সে শিশুদের ইচ্ছে থাকে অনেক। আমি অনেক স্কুলে যাই ওকে ভর্তি করাতে। প্রথমে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। আমি কান্না কাটি করে শিক্ষকদের রাজি করিয়েছি।
এমন করেই সন্তানদের মায়ায় কেটে যায় আমাদের বাবার জীবন। বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবাকে শুভেচ্ছা।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৭ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
এমএন/জিপি/এসআইএস