এরপর উলিপুরের মিষ্টান্নের কারিগর মনমোহন হালাই তৈরি করেন ক্ষীরমোহন। একই সময়ে উলিপুর বাজারে স্বল্প পরিসরে ক্ষীরমোহন তৈরি শুরু করেন সুনীল চন্দ্র মদক।
এখন এই ক্ষীরমোহন দেশ জয় করে ইউরোপ, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও ভারতে নিয়মিত যাচ্ছে। রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন মিষ্টি ঘরে যাচ্ছে উলিপুরের ক্ষীরমোহন।
এই মিষ্টি তৈরিতে উপকরণ হিসেবে দুধ, চিনি, ঘি, দুধের ছানা, ময়দা, তেজপাতা ও ছোট এলাচ ব্যবহার করা হয়। এক কেজি ক্ষীরমোহন তৈরি করতে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি দুধ প্রয়োজন হয়। তাই গরুর দুধের ওপর নির্ভর করে ক্ষীরমোহনের বাজারমূল্য। উলিপুরে বর্তমানে প্রতিকেজি ক্ষীরমোহন ৩৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি দোকানে দিনে খুচরায় এক থেকে দেড় মণ ক্ষীরমোহন বিক্রি হয়।
তবে ঢাকা, রংপুরের পাইকারি দোকান ও বিদেশে অধিক পরিমাণে যাচ্ছে ক্ষীরমোহন। ইউরোপ, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও ভারতে নিয়মিতভাবে ক্ষীরমোহন পাঠানো হচ্ছে।
পাবনা ভাগ্যলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পরিচালক রনি মদক বাংলানিউজকে বলেন, ক্ষীরমোহন দেশের চেয়ে বিদেশে বেশি যাচ্ছে। দোকানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় মণ ক্ষীরমোহন বিক্রি হয়। এর থেকে কয়েকগুণ ক্ষীরমোহন ঢাকাসহ বিদেশে যাচ্ছে। লন্ডন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও ভারতে আমাদের ক্ষীরমোহন বিক্রি হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষীরমোহন বিদেশে পাঠাতে সরকারের অধিক পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।
ক্ষীর ও মোহনের সংমিশ্রণে তৈরি ক্ষীরমোহন। ক্ষীর বলতে মিষ্টির রসকে বোঝানো হয়েছে। এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে এর সঙ্গে নানা ধরনের মসলা মিশিয়ে তৈরি করা হয় রস। মিষ্টির এই রসকে স্থানীয়ভাবে ক্ষীর বলা হয়। অন্যদিকে মোহন বলতে সাদা মিষ্টির অংশকে বোঝানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এর নাম ল্যাংচা। এটাকে সফট করতে দুধ, ঘি, ছানাসহ ব্যবহার করা হয় নানা পদের মসলা। ফলে মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা হারিয়ে যায়।
কুড়িগ্রামে এলে ক্ষীরমোহন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ভিআইপিদের। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় আসেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের ক্ষীরমোহন দিয়ে আপ্যায়ন করানো হয়।
পাবনা মিষ্টান্ন দধিঘরের মালিক গোবিন্দ কুমার ঘোষ বলেন, ক্ষীরমোহন বাইরের দেশে যায়। মালয়েশিয়া, জাপান, লন্ডনে যায় ক্ষীরমোহন। বিভিন্ন দেশে ক্ষীরমোহন নিয়ে যাওয়া হয়। অর্ডার দিলেই আমরা ক্ষীরমোহন বানিয়ে দেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষীরমোহন খাওয়াইছি। আমার হাতের বানানো।
ক্ষীরমোহন বানানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুধের খাঁটি ছানায় মিষ্টি তৈরি করা হয়। এই মিষ্টি বা মোহন প্রথমে গরম চিনির রসে ভেজে নেয়া হয়। মিষ্টি ভাজার পরে রস ঝরিয়ে ফেলা হয়। চিনির রসের পরে এই মিষ্টি ফের দুধে জ্বাল দেয়া হয়। দুধ ক্ষীরে পরিণত হয়। যখন মিষ্টির ভেতরে ক্ষীর প্রবেশ করে তখনই তৈরি হয় ‘ক্ষীরমোহন’। এই মিষ্টি একমাত্র উলিপুরেই বানানো হয়।
ক্ষীরমোহন বিক্রেতারা আরো জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঢাকায় ক্ষীরমোহন নিয়ে যান। নমিশন নিতে কুড়িগ্রামের নেতাকর্মীরা ঢাকায় এমপি-মন্ত্রীর বাসায় নিয়ে যান ক্ষীরমোহন।
এছাড়া চাকরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রী-সচিবদের মন জয় করতেও ক্ষীরমোহনের জুড়ি নেই বলে জানান স্থানীয়রা।
ক্ষীরমোহন বিক্রেতারা জানান, ভোজনের রসনায় ক্ষীরমোহনের জুড়ি নেই। ১৯৭২ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা কানাই লাল সরকার এখানকার মনমোহন হালাইয়ের কাছ থেকে ক্ষীরমোহন কেনেন। এর পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আপ্যায়ন করেন। ক্ষীরমোহন খেয়ে ভূঁয়সী প্রশংসা করেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথকেও ক্ষীরমোহন খাওয়ানো হয়েছে বলে জানান উলিপুরের ক্ষীরমোহন বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৭
এমআইএস/জেডএম