পলাশী ও তৎপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে লর্ড মেকলে বলেছেন, আমরা যখন ভারতীয়দের পরাভূত করি, তখন তারা সংখ্যায় ছিল আমেরিকার অধিবাসীদের তুলনায় কম করে দশ গুণ। তাদের শিক্ষা-দীক্ষার মান ছিল বিজয়ী স্পেনীয়দের সমতুল্য।
অতএব, ইংরেজ ব্যাখ্যাকারদের কাছেও এই পরাজয় কাম্য ছিল না; কাক্ষিতও ছিল না। ভেতর ও বাইরের ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কূট-কৌশলের কারণে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার পরাজয় হয়েছিল। কিন্তু এদেশীয় তথাকথিত ইতিহাসবিদরা, এসব বাস্তব মূল্যায়নের বদলে অনেক কাল্পনিক কারণ দাঁড় করান সিরাজের পরাজয় সম্পর্কে। যেমন, তৎকালীন ইতিহাসকার সালীম প্রণীত রিয়াজের একটি ভাষ্য উল্লেখ করা যায়। যাতে পলাশীর পুরো বিষয়টিই হিংসাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয় এবং পলাশীর দুর্যোগকে ‘বিধাতার দান’ মর্মে উল্লেখ করা হয়!
সালীম বলছেন, “বাংলার ইতিহাসের এই বিপ্লবের ফলে প্রকৃতপক্ষে এদেশীয় শাসনের স্থানে ইংরেজরা এদেশের সর্বময় কর্তা হয়েছিল। এই পরিণতিকে জনসাধারণের কল্যাণার্থে বিধাতার কল্যাণময় দানরূপে গণ্য করা যেতে পারে। তৎকালে বাংলার জনসাধারণ নৈতিক অধঃপতের চরম সীমায় পৌঁছে ছিল। কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিষ সর্বত্র প্রবেশ করেছিল। মিথ্যাচার ও অর্থগৃধ্রুতা তাদের অন্তরের অন্তস্থলে বাসা বেঁধেছিল। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও অর্থলোভের মোহে তারা তাদের রাজার যৌবনসুলভ ত্রুটি ও পারিবারিক ঈর্ষার সুযোগ নিয়েছিল। তারা সর্বপ্রকার কৃতজ্ঞতার ও সম্মানের মনোভাব ত্যাগ করে। এই কারণে তাদের নৈতিক অধঃপতন রোধের জন্য মুসা পয়গম্বরের মতো একজন রক্ষাকর্তার প্রয়োজন হয়েছিল। দেশের পাপ দূর করে জনসাধারণকে উদ্ধার ও সংস্কারের জন্য বিধাতা তাই সাগর পার থেকে ইংরেজদের মাধ্যমে উদ্ধার কর্তা প্রেরণ করেছিলেন। ”
কি মারাত্মক ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডুকতা ও বানোয়াট-আবেগ দিয়ে সিরাজের পতনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। দেশের সংস্কৃতি, ঐক্য, নেতৃত্ব ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট দিকগুলোতে চিহ্নিত না করে তৎকালীন ঐতিহাসিকরা পরবর্তী শাসক ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় অদৃষ্টের উপর সকল দোষ চাপিয়ে আসল ঘটনা আড়ালের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। এবং বিদেশি ইংরেজের আগ্রাসন ও দখলদারিত্বকে বিধাতার আর্শীবাদ বলার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এ ধরনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ মোটেই মুর্খতা-প্রসূত নয়, দালালির নির্লজ্জ দাস মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
বস্তুতপক্ষে, ১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয়কে স্মরণ করা দরকার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মনে রেখে; কিভাবে একটি স্বাধীন জনপদ তার স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে পারে তা ফিরে দেখার জন্য। কারণ, আঠারো শতকের প্রথম দিক থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা যেমন ছিল, তা যেন আর কখনোই ঘটতে না পারে, সে চেষ্টা সকলেরই থাকা দরকার। একটি গভীর ষড়যন্ত্র কিভাবে মামুলী একটি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি দেশই শুধু নয়-একটি অঞ্চল-এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে, এনেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া, তা পলাশী ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন ঘটনায় দেখতে পাওয়া যাবে না। এ জন্যই মাত্র কয়েক ঘণ্টার এই যুদ্ধটিকে গুরুত্বের দিক থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা হিসাবে গণ্য করা হয়।
এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, পলাশীর যুদ্ধ রাজায় রাজায় সংঘটিত হয়নি। যুদ্ধ হয়েছে বাংলার নবাব এবং একটি বিশ্ব পুঁজিবাদি বাণিজ্যিক কোম্পানির মধ্যে। এক রাজার পতন হলে আরেক রাজার আবির্ভাব ঘটে, জীবন চলতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নবাবের পতন হয়েছে একটি কোম্পানির হাতে, সাত সমুদ্রের ওপার থেকে আসা একটি বিদেশি বাণিজ্যিক কোম্পানি দেশের শাসকে পরিণত হলো। সনাতন রাজনীতিতে রাজার শাসনে থাকে প্রজাকুলের নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনিয়তা, যা একটি বিদেশি-মুনাফালোভী-বেনিয়া কোম্পানির থাকার কথা নয়; থাকার কারণও নেই। অথচ এহেন একটি কোম্পানিকেই রাজনৈতিক বিষয়ে শুধু টেনে আনা নয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রধান অংশীদার ও নিয়ামক শক্তিতে পরিণত করলো এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা। বিদেশিদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অপরাপর বিষয়ে ডেকে আনার পরিণতি কত মারাত্মক হয়েছিল, তা পরবর্তীতে গবেষকরা উন্মোচিত করেছেন।
তত্ত্বগত ও নীতিগত দিক দিয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিবেচনা মুনাফা। মুনাফাকে মোক্ষ করেই শাসিত হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা রাষ্ট্র; অন্তত কোম্পানির প্রথম ৫০ বছর। এ সময় দেখা যায়: দ্বৈতশাসন, নিলামি বন্দোবস্ত, দশ সালা বন্দোবস্ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, পত্তনি ব্যবস্থা, সূর্যাস্ত আইন, ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ, সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে মানবাধিকারের পতন ইত্যাদি। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে নবাবি শাসনামলের ইতিহাসে কোন একটিও দুর্ভিক্ষ দেখা যায় নি, এমন কি কোন প্রজা অসন্তোষ বা প্রজা বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে, অর্থাৎ কোম্পানি আমলে দেখতে পাওয়া যায় অভাবনীয় অভাব, দুর্ভিক্ষ ও প্রজাবিদ্রোহ। দেখা যায় জমিদার সমাজের মধ্যেও অসন্তোষ। সূর্যাস্ত আইনের ফলে নিলামে জমিদারি বিক্রয়, নতুন জমিদারের আবির্ভাব, প্রজাদের ওপর খাজনা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সরকার জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা অন্য কোন কল্যাণকর দায়িত্বের ধার দিয়েও যায় নি; কারণ তা মুনাফার হিসাবে মেলে না। ফলে নবাবি আমলের মাদ্রাসা, পাঠশালা, টোল প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোম্পানি আমলে বিলীন হয়ে যায়। বিলীন হয় গ্রাম পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সুখ-নিরাপত্তা।
ব্যক্তি ও রাষ্ট্র পর্যায়ের বাইরেও পলাশীর ঘটনা বিশ্ব-অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। উপনিবেশবাদ আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষতিকর দিক, এ কথা সর্বজনবিদিত। আর এহেন পলাশীর যুদ্ধ-নামক-ঘটনার মাধ্যমে প্রথম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলায়। এ কথা ইতিহাসমনস্ক মাত্রই জ্ঞাত যে, তৎকালীন বঙ্গদেশই হলো বিশ্বের প্রথম আধুনিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। এর আগে ইউরোপের অনেক দেশ মহাসাগরীয় অঞ্চলের জনশূন্য জায়গায় কলোনি বা উপনিবেশ স্থাপন করেছে বা কোনও জনবহুল জায়গায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছে; কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকার কোথাও জনবহুল রাজ্য দখল করে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। ফলে বিশ্ব ইতিহাসের পাতাতেও বাংলাই প্রথম ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র; যার উৎপত্তি পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক পরাজয়ের মাধ্যমে।
বাংলায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে আন্তঃমহাসাগরীয় বাণিজ্যে ব্রিটেন অভাবনীয় সুবিধা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে ও সামরিক ক্ষমতায়। স্বাধীন ও স্বনির্ভর, ঐতিহ্যবাহী বঙ্গদেশও এর কুপ্রভাবে পরিণত হলো ব্রিটিশ শিল্প-পণ্যের একটি বন্দি বাজারে এবং ব্রিটিশ শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের উৎসরূপে। মুনাফার লোভে ব্রিটেনের অনুকরণে ইউরোপের অধিকাংশ সাগর উপকূলীয় রাষ্ট্রই ব্রিটেনের অনুরূপ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। এবং এভাবেই উপনিবেশবাদ থেকে সূত্রপাত ঘটে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের।
বাংলা, ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, পলাশীর ষড়যন্ত্রের ছিদ্র পথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে শুরু করে ক্রমেই সমগ্র ভারতে এবং আরও পরে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থাপন করে বাণিজ্যিক বলয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শিল্প-বিপ্লবে এবং পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠায়। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রিটেনের আদলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
তত দিনে সোনার বাংলা ব্রিটিশ লুণ্ঠনের মাধ্যমে ক্ষত-বিক্ষত ও পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। কুটির শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, জন-জীবন বিধ্বস্ত হয়। নানা রোগ, ব্যাধি, মহামারীতে জীবন অতীষ্ঠ হয়েছে মানুষের। সে এক নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, পাগলা বিদ্রোহ ইত্যাদি জনপ্রতিরোধের মাধ্যমে বাংলার কৃষিজীবী-গ্রামীণ মানুষ বরাবরই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনের পর্যায়গুলো ইতিহাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। শেষ।
পূর্ববর্তী পর্ব
কে এই ক্লাইভ?
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৭
জেডএম/