যথারীতি এক-দু’জন বন্ধু-বান্ধবীর হাতে এক কলমে চাররঙা শিষের মতো এই টিপ-ছাতাও চলে এলো। সবার ক্লাসে সবার ঈর্ষা আর সৌভাগ্য নিয়ে এরকম থাকে দু’-একজন।
নাহ, টিপ-ছাতা হয়নি। তবে রাগ করে হোক বা ইচ্ছে করেই, ঘোর বরষার দিনে ওই কালো কাপড়ে মোড়ানো কাঠের বাট বাড়িতে ফেলে যেতাম। খুব করে চাইতাম, ঠিক ছুটির সময় বৃষ্টি হোক। এলেও কী শান্তি ছিলো! বারান্দায় দাঁড়িয়ে অংক স্যারের কড়া হাঁক, কেউ যাবে না, বৃষ্টি কমলে তারপর।
বৃষ্টি একটু কমেছে কী কমেনি, বিরস বদনে স্যারকে গিয়ে বললে তার রাশভারী জবাব, কমেছে নাকি!
(মিনমিন করে) জ্বি স্যার।
পকেটে থাকতো বড় পলিথিনের ব্যাগ। বই ভেতরে ঢুকিয়ে এক হাতে বুকে জাপটে, অন্যহাতে জুতা। স্যার উঁকি মেরে দেখার আগে ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই দে ছুট!
প্রিয় কোনো সহপাঠিনী ছাতা মাথায় টিপটিপ বৃষ্টির মতো হেঁটে যেতো। ইচ্ছাকৃত চিৎকারে পেছন থেকে তাকে চমকে দিয়ে পগার পার। তার অকৃত্রিম চমক যেনো ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যেতো (যায়)’। ওই বয়সে ওইটুকুই যা পুলক।
ততোদিনে কয়েক ‘শ্রাবণের বারিধারা ঝরিয়াছে বিরামহারা’। বাজারে আসে ভেঙে ছোট করে ফেলার সুবিধা নিয়ে ফোল্ডিং ছাতা। ভাঁজ করে কভারে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। বিদেশে থাকা ছোটচাচা অল্প কয়েকদিন ব্যবহার করে এরকম একটি ছাতা দিয়ে যান। খুব ডাটের সঙ্গে রোজ সঙ্গে নিয়ে যাই। কিন্তু বৃষ্টি আর আসে না! এমন সৌখিন ছাতা বন্ধুদের দেখাতে না পারার কালমেঘ মনের আকাশে গর্জে ওঠে। তা বৃষ্টি হয়ে ধুয়েও যায়।
একদিন অঝোরে বৃষ্টি নামলো। বাড়িতে ভুলে ছাতা রেখে আসা প্রিয় বান্ধবীটি মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে। আকাশের সব মেঘ যেনো জমা হয়েছে তার কাজল চোখে। এরপর একছাতা, দু’টি মাথা— ছাতার বাটে দু’টি কিশোর হাতের ছোঁয়াছুঁয়ি। সেই শ্রাবণ মেঘের দিন ফিরে আর আসবে কি কখনও?
এহেন নস্টালজিয়ায় কালিদাসের মেঘদূতের একটি শ্লোক বড় যথার্থ লাগে,
‘ধারাসিক্তস্থলসুরভিণস্ত্বন্মুখস্যাস্য বালে
দূরীভূতং প্রতনুমপি মাং পঞ্চবাণঃ ক্ষিণোতি
ধর্মান্তেঽস্মিন্বিগণয কথং বাসরাণি ব্রজেযুঃ
দিক্সংসক্তপ্রবিততঘনব্যস্তসূর্যাতপানি’
অর্থ? আজ নাই বা বলি!
এরপর সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তাকে দেওয়া; শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তার কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার বয়স। মনের অন্দরে কানাকনি পড়ে— শ্রাবণার জন্য? ফিসফিসিয়ে কতো কথা— শ্রাবণার সঙ্গে?
নক্ষত্রের নাম শ্রাবণা। প্রাচীনকালে উপমহাদেশে পঞ্জিকা ‘পঞ্চাঙ্গ’ নামেও পরিচিত ছিলো। কারণ, এতে ছিলো পাঁচটি অঙ্গ: বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে। তখনও বছরকে ভাগ করা হয়েছিল বারো মাসে। সেই মাসগুলোর নাম ছিলো: তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্স, শুচি, নভস, নভস্য, ইষ, উর্জ, সহস ও সহস্য। পরে নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা বারো মাসের নামকরণ হয়েছে।
কিন্তু আমি তা মানবো কেন? শ্রাবণা সেই চমকে ওঠা বালিকা, ছাতা রেখে আসা কিশোরী কিংবা সারাটা দিন-মেঘ-বৃষ্টি দিয়ে দেওয়া তরুণী— তার প্রেমিক শ্রাবণ।
আরও পরিণত বয়সের শ্রাবণ হয়তো তাকে মনে করে গুলজারের কবিতার লাইনে,
‘কিসি মওসম কা ঝোঁকা থা
জো ইস দিওয়ার পর লটকি হুই
তসবির তিরসি কর গ্যায়া হে
গায়ে সাওয়ান মে ইয়ে দিওয়ারে
ইউ সিলি নেহি থি
অউর সিলান ইস তারাহ বেহতি হে জ্যায়সে
খুশকা রুখসারো পে গিলে আঁসু চালতে হে…’
মহাজাগতিক ঘুর্ণনে আবারও শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। অস্ফুটে যেনো বলে যায়,
‘দূর দিবসের তটে মনের আঁধার পটে
অতীতের অলিখিত লিপিখানি লেখা কি?’
জিজ্ঞাসা আপন অন্দরে চুপটি করে এসে বসে থাকে। তার চোখে অবোধ্য শিলালিপির শূন্যতা। যা পাঠোদ্ধারে মেঘের ভাষাবিজ্ঞান এখনও পড়ে চলেছি।
এক ফাঁকে তাকেও জিজ্ঞাসা করি, এখনও কী কোনো শ্রাবণাকে চমকে দাও কিংবা ফিরে আসো এক ছাতার নিচে? তাকে সারাটা দিন-মেঘ-বৃষ্টি যে দিয়ে দিতে! নাকি এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে কোনো আধুনিক শ্রাবণার ফেসবুক স্ট্যাটাসের আলোড়ন, ‘Rain it pours, and it’s dancing in my soul now; Rain it pours, and it drowns away my thoughts…’।
সে যাই হোক, একবছর পর শ্রাবণের সঙ্গে দেখা। অনেক খিচুড়ি পাকানো গল্প, অনেক মুড়িমাখা আড্ডা, বৃষ্টিভেজা দিন, অনেক হাঁটু-কাদা বিরক্তি— আরও কতো কী! শ্রাবণ, শ্রাবণই। সেই পুরনো পুলক, শিহরণ, অনুরণনে ভরপুর। ‘শ্রাবণের ধারার মতোই তা পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…’। অবিরাম, অনাদি…।
কখন ভিজে গেছি টেরই পাইনি। এই এক জ্বালা, শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হলেই জোর করে ভেজাবে। আরে ব্যাটা, এখনও কী আর ছোট আছি নাকি! সে বিরক্তি গায়ে মাখে না। কিন্তু ভেতর থেকে ভালো ঠিকই লাগে। সেইসব বৃষ্টিদিন আর শ্রাবণাদের কথা মনে পড়ে। স্মৃতিরা হৃদয়ের শাখা ধরে নাড়া দেয়। যেনো আবার শ্রাবণ হয়ে এলো ফিরে...।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
এসএনএস