কিন্তু একদিন কেউ একজন শত্রুতার কারণে ভেলুর গায়ে একটা আস্ত রড ঢুকিয়ে দিলো। রড তার ফুসফুসে গর্ত করে ফেলে, ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে নিঃশ্বাস।
ভালমতো খোঁজ-খবর নিয়ে তারা কেয়ার ফর প’স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেলেন। সেখানে ভেলুকে নিয়ে গেলে শুরু হয় চিকিৎসা। তিনবার সার্জারি করতে হয় ভেলুর। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে ওঠে। আগের মতোই দৌড়-ঝাপ খেলায় মেতে উঠে সে।
রাজধানীর বুকে একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় এভাবেই চলছে সিএফপি (কেয়ার ফর প’স) নামের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
সিএফপি মূলত কাজ করে রাস্তায় জন্মানো পোষা প্রাণী নিয়ে, যাদের কোনো মালিক নেই বা মালিকের সামর্থ্য নেই পোষা প্রাণীর চিকিৎসা করানোর। প্রতিদিনই এখানে উপস্থিত হচ্ছে অসুস্থ কোনো কুকুর বা বিড়াল। এদের নিজ খরচে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
তাছাড়া সিএফপির রয়েছে নিজস্ব এনিমেল রেসকিউ টিম। দুর্ঘটনা কবলিত কোনো প্রাণীকে উদ্ধার করতে এ রেসকিউ টিম সদাতৎপর।
রাস্তার কুকুর-বিড়ালদের সেবার লক্ষে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছা কেন জন্মালো, জানতে চাইলে সিএফপির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম বাংলানিউজকে জানান, বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ড্রেনের ভিতর থেকে দুটো কুকুরকে উদ্ধার করে বাসায় পালতে শুরু করেন। শখ করে তাদের নাম রাখেন বস্কো ও সিজার। অল্প সময়েই পরিবারের সদস্যে পরিণত হয়ে এই দুই বোন।
কিন্তু কিছুদিন পর বস্কো এক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। প্রিয় পোষা প্রাণীটির মৃত্যু প্রবলভাবে শোকগ্রস্ত করে তোলে সৌরভ শামীমকে। তিনি এমন কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে রাস্তার কোনো কুকুর যেন বিনা চিকিৎসায় আর কখনও না মারা যায়।
এরপর থেকে তিনি রাস্তার কোনো কুকুরকে অসুস্থ অবস্থায় দেখলে তাকে নিজ বাসায় রেখে চিকিৎসা করানো শুরু করেন। ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচিত হন অনেকের সঙ্গে। বাড়তে থাকে শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংখ্যা। তাই আরও বড় পরিসরে আরও ভালো চিকিৎসা সেবার উদ্দেশ্যে কয়েকজন সদস্য নিয়ে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে গড়ে তোলেন সিএফপি। বর্তমানে রাজধানীর জিগাতলার একটি আবাসিক ভবনে অবস্থিত তাদের ক্লিনিক ও এনিমেল শেল্টার।
সৌরভ শামীম জানান, তার লক্ষ্য সমগ্র বাংলাদেশকে জলাতংক মুক্ত করা। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলায় কুকুরের ভ্যাক্সিন কার্যক্রম চালিয়েছে সিএফপি টিম। ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে বান্দরবানের মতো দূরবর্তী এলাকাতেও।
অল্প সময়েই বেশ কিছু ঘটনা সৌরভ শামীমের সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিরপুরে দুটি ভুবন চিল বিক্রির খবর মেলে। এরপর ক্রেতা সেজে বিক্রেতার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এভাবে স্টিং অপারেশন চালিয়ে ভুবন চিল দুটোর ভিডিও ফুটেজ ধারণ করতে সক্ষম হন। ভিডিও ফুটেজটি প্রমাণ হিসেবে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের কাছে উপস্থাপন করলে বনবিভাগ ও পুলিশের সহায়তায় ভুবন চিল দুটো উদ্ধার করা হয়।
একবার একটা কুকুরকে মেরে চোখ তুলে ফেলেছিলো এক ব্যক্তি। এরপর সিএফপি টিম ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশ কেস করে এবং দোষীকে শাস্তির ব্যবস্থা করে। প্রাণী নির্যাতনের কারণে পুলিশ কেস ও শাস্তির ঘটনা বাংলাদেশে সেটাই প্রথম।
এরকম আরও অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে সিএফপির কার্যক্রম। ধারাবাহিকতায় গত এপ্রিল মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধিত হয় কেয়ার ফর প’স।
শুধু রাস্তার কুকুর-বিড়ালই নয়, বাড়ির পোষা প্রাণীদেরও চিকিৎসাসেবা দেয় সিএফপি।
পোষা বিড়াল সিম্বারকে চিকিৎসার জন্য সিএফপিতে নিয়ে আসেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা উর্মী। তিনি বলেন, ঢাকার অন্য ভেটেরিনারিগুলোতে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। সে তুলনায় এখানে অনেক কম খরচে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায়।
এভাবেই আশপাশে কোনো প্রাণী বিপদগ্রস্ত হলে প্রতিনিয়ত ঘটনাস্থলে ছুটে চলছে সিএফপির রেসকিউ টিম। দুর্ঘটনায় আহত, অসুস্থ অথবা মানুষের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের শিকার হওয়া প্রাণীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা। জলাতংক দূর করতে দেশের দূর প্রান্তে চলছে ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্পেইন। প্রাণী নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলছে প্রতিবাদ। মোকাবেলা করতে হচ্ছে নিত্যনতুন ঘটনা। সেই সঙ্গে এগিয়ে চলছে সিএফপি।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৭
এনএইচটি/এএ