শুধু ২২ বছর আগের পুরনো ক্যালেন্ডার নয়, পোস্টাল মিউজিয়ামে দেখা যাবে ডাক বিষয়ক বেশ কিছু দুর্লভ-দর্শনীয় বস্তু। যা এই ফেসবুকীয় টুংটাং শব্দের দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবে রানারের ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজার সময়ে।
অপরদিকে আমাদের বাঙালিয়ানার লেটার বাক্সগুলো ছিলো চার কোনাচে বাক্সের মতো হলুদ রঙের। শুধু কি এই লেটার বক্সের ইতিহাস? পোস্টাল মিউজিয়ামে রয়েছে আরও হাজারটা তথ্য। রয়েছে ডাক বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বস্তু।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা জিপিও’তে ক্ষুদ্র পরিসরে একটি মিউজিয়ামের সম্প্রসারণ রূপই বর্তমানের এই পোস্টাল মিউজিয়াম। যার অবস্থান রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকার ডাক ভবনের তৃতীয় তলায়। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ডাক বিভাগের মহাপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডাক অধিদপ্তরে গড়ে ওঠে এই মিউজিয়ামটি। ঢাকা ডাক ভবনের মূল ফটক পার হলেই চোখে পড়বে এই মিউজিয়ামের সাইনবোর্ড। পোস্টাল মিউজিয়ামে প্রবেশ করা মাত্রই দৃষ্টিগোচর হবে সমগ্র পোস্টাল সার্ভিসের একটি বাস্তবভিত্তিক মডেল। এর পাশেই রয়েছে চারটি সার্কেল প্রধান বা পোস্টমাস্টার জেনারেলের কার্যালয়ের মডেল। প্রচারের আড়ালে থাকা মিউজিয়ামটিতে রয়েছে রানারের প্রতিকৃতি। যা দেখামাত্রই আপনার স্মৃতিতে ভেসে উঠবে সুকান্তের সেই বিখ্যাত কবিতা। ‘রাতে রানার ছুটেছে, তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে/ রাতে রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’।
পোস্টাল মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন ধরনের লেটার বাক্স, যা মহারানি ভিক্টোরিয়া থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত। এছাড়া ১৯৮০ সালের নয় মণ ওজনের একটি লেটার বাক্সও রয়েছে এখানে। আছে বার্মিংহামে তৈরি সাত মণ ওজন করা যায় এমন একটি স্কেল ছাড়াও আরও ১০-১২টি স্কেল।
১৮৭০ সালের ডাক প্রহরীদের ব্যবহৃত বর্শা, ব্রিটিশ আমলের ধাতব স্ট্যাম্প প্যাড, ডাক হরকরার ব্যবহৃত রেক্সিন ও চামড়ার ব্যাগ, ১৮৭৮ সালের তৈরি ছোট্ট টেবিল ঘড়িসহ বেশ কয়েকটি দেয়াল ঘড়ি, ফ্রাংকিং বা স্বয়ংক্রিয় পত্র বাছাই মেশিন, অনেকদিন আগের বেশ কিছু পোশাক এবং টুপি সংরক্ষিত আছে এখানে, যা রানার কিংবা পিয়নরা ব্যবহার করতো।
এছাড়া পোস্টম্যান, হেড পোস্টম্যান ও অন্যান্যদের ব্যবহৃত ব্যাগমানি কটব্যাগ, লণ্ঠন, বিউগল, তলোয়ার, বন্দুক, ডিমলাইট, ছুরি ইত্যাদি সংরক্ষিত রয়েছে মিউজিয়ামটিতে, যার বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের।
এর প্রত্যেকটির বিভিন্ন গল্পও রয়েছে বলে জানালেন পোস্টাল মিউজিয়ামের নিরাপত্তা কর্মী আব্দুল মালেক। বিভিন্ন ধরনের বিউগল দেখিয়ে তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলে রানাররা খেয়ার মাঝিকে বা স্টেজের অন্য রানারকে সংকেত ধ্বনি দেওয়ার জন্য এই বিউগলগুলো ব্যবহার করতেন। এছাড়া ঘন জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার সময়ও এগুলো সহ-নিরাপত্তার জন্য রানাররা বিভিন্ন বন্দুক বা তলোয়ার ব্যবহার করতেন।
এই মিউজিয়ামে আরও রয়েছে পুরনো দিনের বহু রূপের বহু আকৃতির তালাচাবি, সিলমোহর, স্ট্যাম্প বাক্স, পোস্টকার্ড, খাম, মোমের বাক্স, অফিসিয়াল সার্কুলার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত ডাক বিষয়ক প্রকাশনা। রয়েছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রকাশনা ‘ডাক প্রবাহ’ এর বিভিন্ন সংখ্যাসহ বিভিন্ন স্মারক গ্রন্থও।
পুরনো দিনের বিভিন্ন মূল্যবান তথ্য সংবলিত বিভিন্ন গ্রন্ত এবং ম্যগাজিনও সংরক্ষিত আছে এখানে। আর সেগুলো থেকে এটা জানা যায় যে, বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষের ডাকঘরে ‘কুইনাইন’ রাখা হতো। এটি তখন ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকায় এই কুইনাইন ওষুধ একমাত্র ডাক বিভাগই মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতো। কারণ, সে সময়ে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো এই ডাক বিভাগ। আরও জানা যাবে মোবাইল পোস্ট অফিস সম্পর্কে, যা একটি নৌকার মাধ্যমে চালু হয় ১৯৫০ সালে।
এই মিউজিয়ামে রয়েছে ডাক বিষয়ক আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন প্রথম সমুদ্র ডাক চালু হয় ১৬৩৩ সালে, প্রথম ডাক সার্ভিস ১৭৭৪ সালে, প্রথম স্ট্যাম্প প্রকাশ ১৮৪০ সালে, প্রথম রেলওয়ে ডাক সার্ভিস ১৮৩০ সালে, প্রথম মুদ্রিত খাম ১৮৩০ সালে, প্রথম পোস্টাল মানিঅর্ডার ১৮৩৮ সালে, এবং প্রথম বিমান ডাক চালু হয় ১৯১১ সালে।
দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তৈলচিত্র লাগানো আছে মিউজিয়ামের দেয়ালে। যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন ডাক বিভাগের সঙ্গে। এদের মধ্যে রয়েছে বিশিষ্ট নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, মহাকবি কায়কোবাদ, ডাকটিকিটের উদ্ভাবক স্যার রোনাল্ড হিল, মন্টেগোমাড়ি, সিভি রমন, হেনরি ভন স্টিফেন এবং শেখ শফিউর রহমান।
দুই কক্ষ বিশিষ্ট পোস্টাল মিউজিয়ামের অপর কক্ষটিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভন্ন দেশের ডাকটিকিটের সম্ভার। এই কক্ষের পুরোটিই সাজানো হয়েছে ডাকটিকেট দিয়ে। যেখানে প্রবেশ করলে ডাকটিকিট ভালোবাসা বা সংগ্রহে আগ্রহী মানুষ নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণে বাধ্য হবেন।
ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নভুক্ত ১৯১টি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য বহন করছে এই ডাকটিকিটগুলো। সারিবদ্ধভাবে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক ডাকটিকিট সুনিপুণভাবে সাজানো রয়েছে এখানে। যা দেখা মাত্রই সংগ্রহের আগ্রহ জাগবে এখানে আগত দর্শনার্থীদের।
তবে ডাক বিভাগ সম্পর্কে এতো বিপুল সংগ্রহ বুকে ধারণ করা পোস্টাল মিউজিয়ামটির কথা এখনো জানে না অনেকেই। দর্শনার্থীর সংখ্যাও কম বলে জানালেন নিরাপত্তা প্রহরী। যারা আসে তাদের বেশিরভাগই ছাত্র বলেও জানালেন তিনি। আর ‘মন্তব্য বহি’ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালের প্রথম সাত মাসে মিউজিয়ামটি পরিদর্শন করেছেন মাত্র ২৩ জন।
‘মন্তব্য বহি’ থেকে আরও জানা গেল, ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এই মিউজিয়ামটি পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকার সহকারী পরিচালক কোহিনূর রহমান। তিনি তার মন্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘পোস্টাল মিউজিয়ামটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম বলেই আজ পাঁচ বছর পর আবার এলাম। কিন্তু এসে কিছুটা আশাহত হলাম। বিগত পাঁচ বছরে নতুন কিছুই সংযুক্ত হয়নি এবং আগের অবস্থায়ই দেখতে পেলাম। ’
২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ার সোলাইমান হোসাইন লেখেন, ‘আমি প্রায় দুই বছর আসি এই জিপিওতে চিঠি পোস্ট করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো প্রায় দেড় বছর পর চোখে পড়লো জিপিও’র একটি পোস্টাল মিউজিয়াম আছে!’
বিগত কয়েক বছরে জাদুঘরে নতুন সংগ্রহ না আনা এবং এর প্রচারবিমুখতার ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সেকশন অ্যাসিসট্যান্ট (অ্যাডমিন) এস এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, জায়গা স্বল্পতা এবং মিউজিয়ামটির প্রচারের জন্য আলাদা কোনো বাজেট না থাকার ফলেই এটি প্রচারবিমুখতায়। এছাড়া সব পোস্ট অফিসেই সংগ্রহের ব্যপারে বলা আছে। নতুন কিছু পেলে অবশ্যই যোগ করা হবে।
মিউজিয়ামটি আধুনিকায়ন করে তা স্থানান্তরের কাজ চলছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, সেখানে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা থাকবে। আর দর্শনার্থী যেন খুব সহজেই এই মিউজিয়ামটি সম্পর্কে জানতে এবং দেখতে পারে, তার জন্যে এটি নিচতলায় প্রধান ফটকের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে, যা বর্তমানের মতোই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এই পোস্টাল মিউজিয়ামটি খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। আসা যাবে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া যেকোনো দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৭
এইচএ/