প্রবেশ পথেই সারি সারি পাম গাছ; দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের লম্বা তাল গাছেরা ডালপালা আর পাতা ভর্তি আলোছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর চারপাশ ডুবে যাচ্ছে সবুজে সবুজে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে ইস্পাত আর কাঁচে ঘেরা অনেকগুলো বিল্ডিং, সূর্যের আলো পড়ে নদীর পানির মতো ঝিলমিল করছে।
গুগলের বিল্ডিংগুলো আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি; বাহির থেকে শুধু ইস্পাত আর সবুজ-নীল কাঁচের মেলবন্ধন দেখা যায়। নান্দনিকতা খুব একটা উপচে পড়ে না। এতো বড় ক্যাম্পাস কেমন করে ঘুরব, এই চিন্তা মাথায় জট পাকাতে থাকলে বুদ্ধিমান গুগল সমাধান বাতলে দেয়; একপাশে চোখে পড়ে গুগলের বিখ্যাত গুগল রঙে রাঙানো বর্ণিল বাইসাইকেল। পর্যটকদের সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা কিনা আমরা নিশ্চিত নই।
গুগল বাইসাইকেল নিয়ে আঁকাবাঁকা ফুটপাথ ধরে বেরিয়ে পড়ব বলে ঠিক করে বাইসাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাই। একটা বাইসাইকেল নিতে গেলে কোথা থেকে যেনো এক গম্ভীরদর্শন নিরাপত্তাকর্মী হাজির। আমাদের কাছে নির্দয়ভাবে ভিজিটর পাস চাইলেন।
আমরা নরম সুরে বোঝানোর চেষ্টা করি, ভাই, অনেক দূর থেকে সত্যিকার গুগল কেমন তা দেখতে এসেছি; আমরা স্রেফ ট্যুরিস্ট, কোনো ভিজিটর পাস নেই। তাছাড়া তোমাদের সিইও সুন্দর পিচাই আমাদের প্রতিবেশী হয়, মানে প্রতিবেশী দেশের; আমাদের সেরা অনুপ্রেরণা তিনি।
ভদ্রলোকের তাতেও সায় মেলে না, দুঃখিতস্বরে বলে, ভিজিটর পাস ছাড়া বাইসাইকেল নেওয়া যাবে না।
আমরা নাছোড়বান্দা, তোমাদের কি ট্যুরিস্টদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই!
ভদ্রলোক এবার মুখে হাসি মেখে উত্তর দেন, গুগলের মাসিভ ক্যাম্পাস সবার জন্য ওপেন। যে কেউ এখানে পায়ে হেঁটে বা নিজের গাড়িতে করে আপনমনে ঘুরে দেখতে পারে। ইট উইল বি আ সেলফ-গাইডেড ট্যুর। লেটস ওয়াক। আমরা অগত্যা পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ভার্চুয়াল জগতে, ইনফর্মেশনের জগতে যাকে ছাড়া চলে না তার বুকে চড়ে বেড়াচ্ছি— এ এক দারুণ অনুভূতি।
সারা ক্যাম্পাসে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণী; তারূণ্যের উত্তাপ আমাদেরও উত্তাল করে তুলে। গুগলার’দের সদা সজীব আর ক্রিয়েটিভ রাখার জন্য কতোসব আয়োজন। বিচ ভলিবল খেলার জন্য দূরের কোনো সমুদ্র সৈকতে যেতে হবে না; এখানেই সেই আয়োজন রেখেছে গুগল। তরুণ-তরুণীরাও হই-হুল্লোড় করে বিচ ভলিবল খেলছে।
কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছি; পাশে থাকা একজন তরুণ বার বার আমাদের দিকে ফিরে দেখছে, সে বুঝতে পারে আমরা ট্যুরিস্ট। বলে, তোমাদের কি কোনো সাহায্য লাগবে। তাকে বরং জিজ্ঞাসা করি, জনাব, গুগলের লোকজন কাজ করে কখন। তার উল্লসিত জবাব, গুগলের চাকরি তথাকথিত চাকরি না, এইটা হলো আমাদের প্যাশন। একটা সমস্যা (প্রজেক্ট) যখন হাতে আসে, তার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি থাকে না, দিনরাতের হিসাব থাকে না। ব্যাকুল হয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান খুঁজি। কারণ, গুগলের ইউজার মানেই হলো সারা বিশ্বের আপামর জনসাধারণ।
তার কথাকে আরও বেশি প্রমাণ করার জন্য হাত তুলে দূরের দিকে দেখায়, ওই যে দেখছো রাস্তায় পার্ক করা ক্যারাভানটা, ওটা হলো মোবাইল সেলুন। গুগলার’দের অনেকে সারাক্ষণ চিন্তার মধ্যে থাকে; তাদের চুল-দাড়ি-গোঁফ কাঁটার কথা মনে থাকে না বা সেলুনে যাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না। তাদের জন্য গুগলের এই অভিনব ব্যবস্থা।
আমরা মোবাইল নরসুন্দরকে দেখে বেজায় আনন্দ পাই। তরুণটি বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে। সে বলে, চলো তোমাদেরকে আরও কয়েকটা উদ্ভাবন দেখাই যা শুধু গুগলেই দেখতে পাবে। তোমরা কি অনসাইট গাড়ি সারাইয়ের ওয়ার্কশপ দেখেছ? আমরা অজ্ঞতা প্রকাশ করি। সে মৃদু হেসে আমাদের সবুজ ঘাস মাড়িয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের দিকে নিয়ে যায়। দেখতে পাই, একটা ক্যারাভানে গাড়ি সারাইয়ের ওয়ার্কশপ। কোথাও এরকম মোবাইল ওয়ার্কশপ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গুগলের অনেকেই ইলেকট্রিক কার ব্যবহার করে। সে আমাদের ইলেকট্রিক কার চার্জিং স্টেশন দেখায়। ইলেকট্রিক কার চার্জিং স্টেশনগুলো সোলার পাওয়ারড। কার পার্কিংয়ের পুরো ছাদ সোলার প্যানেল দিয়ে বানানো হয়েছে। ভীষণ বিস্মিত হই গুগলের এই আইডিয়া দেখে।
গুগল ক্যাম্পাসের সর্বত্রই দেখা যায়, গুগলের নানান রকম ‘গো গ্রিন’ ইনিশিয়েটিভ। বোনাস হিসাবে তরুণের সঙ্গ পেয়ে আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ হই। তরুণটি আমাদেরকে ম্যাজিক্যাল গুগল ক্যাফের দিকে নিয়ে যায়। বাইরে খোলা লনে টেবিল-চেয়ার দিয়ে সাজানো এই আউটডোর ক্যাফেটেরিয়াটি। ক্যাফের অতিথিদের ছায়া দেওয়ার জন্য রয়েছে গুগল রঙের বড় বড় আমব্রেলা। চারপাশের সবকিছুতেই গুগল কালারকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস বেশ নজর কাড়ে।
জানতে পারি, এই ক্যাফের সবকিছু ফ্রি গুগলজীবীদের জন্য। খাদ্য তালিকা নাকি কালার-কোডেড- সবুজ মানে স্বাস্থ্যকর, হলুদ মানে অতো স্বাস্থ্যকর নয়, লাল মানে চিন্তাভাবনা করে খেও নতুবা কিডনি ফেইল করার চান্স আছে।
গুগল ক্যাফে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই, চোখ আটকে যায় অ্যান্ড্রয়েড স্ট্যাচুতে। অ্যান্ড্রয়েডের প্রতিটি ভার্সনের যেমন লোগো থাকে, তারই রেপ্লিকা হিসাবে বানানো হয়েছে অ্যান্ড্রয়েড স্ট্যাচু। ভবিষ্যতে অ্যান্ড্রয়েডের কী ভার্সন আসবে তারও একটা আগাম ধারণা দেওয়া হয়েছে। স্ট্যাচুর পাশে দাঁড়িয়ে ট্যুরিস্টদের ফটো তোলার হিড়িক দেখে আমরাও দাঁড়াই ছবি তুলতে। তরুণটি ব্যস্ত হয়ে আমাদের নিয়ে যায় টি-রেক্স ডাইনোসরের স্কেলেটন স্ট্যাচু দেখাতে। সবুজ চত্বরে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় ডাইনোসরটিকে দেখিয়ে তরুণটি হাসতে হাসতে বলে, এই ডাইনোসরটি এখানে রাখার উদ্দেশ্য হলো গুগলার’দের মনে করিয়ে দেওয়া যে, সবসময় ক্রিয়েটিভ থাকো কিন্তু গুগলকে ডাইনোসর বানিয়ে ফেলো না।
আমাদের মন খারাপ করিয়ে দিয়ে তরুণটি বিদায় জানিয়ে বলে, গুগল কাম্পাসের সব যে কেবল যান্ত্রিক তা-না, তোমরা অবশ্যই কাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন পাবলিক আর্টওয়ার্কগুলো দেখবে। আরও আছে ভাস্কর্য গার্ডেন যেখানে বিখ্যাত ব্যক্তিদের পাথরে বানানো আবক্ষ মূর্তি; উদ্দেশ্য, গুগলজীবীদের অনুপ্রাণিত করা। খুঁজে খুঁজে ভাস্কর্য গার্ডেন গিয়ে হাজির হই আর ভাবি গুগল কতোটা মহৎ; বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্মান জানিয়ে তারা নিজেরাও আরও মহৎ হয়ে উঠছে।
হঠাৎ দেখা যায় বাতাসে ধোঁয়ার রেখা আর নাকে লাগে রুচিকর মাংস পোড়ানোর সুগন্ধ। আমাদের খিদে নেই তারপরও বারবিকিউয়ের সুগন্ধে খিদে চনমন করে উঠে, আমরা ধোঁয়ার উৎস ধরে এগিয়ে যাই। মাঠের একপাশে বারবিকিউ হচ্ছে। আমাদের মতো বাদামি বর্ণের অনেক তরুণ-তরুণী বারবিকিউ চুলা ঘিরে আছে। নিশ্চয় সাউথ এশিয়ান হবে অথবা বাংলাদেশিও হতে পারে।
আমরা বাংলায় কথা বলে উঠি, বাংলাদেশি কেউ আছেন নাকি! থাকলে আওয়াজ দেন, ভাই। আমাদের কথা শুনে এক তরুণ ফিক করে হেসে ফেলে, এগিয়ে এসে হাত মেলায়, বলে, আমি ইন্ডিয়া (কলকাতা) থেকে এসেছি দাদা, কিছু লাগবে? প্রাথমিক অন্তরঙ্গতা শেষে অবারিত প্রশ্নটা করে ফেলি তাকে, বাংলাদেশি তরুণরা কেমন করে গুগলে চাকরি পেতে পারে? তিনি আমাদের কৌতুহল মেটায়, গুগলে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন কিছু না। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, ক্রিয়েটিভ হতে হবে। আমরা পারছি, তোমরা কেন পারবে না! সো গেট প্রফেশনাল এক্সপেরিয়েন্স, এক্সসেল ইন কোডিং, টেল হাউ ইউ ক্যান হেল্প গুগল, বি স্পিরিটেড লাইক গুগল। ব্যস এ’টুকুই! তার কথায় আমরা অনুপ্রাণিত হই। বাংলাদেশের তরুণরা নিশ্চয় পারবে একদিন।
পায়ে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমাদের গাড়ি নিয়ে সামনে আগাই। আমরা টেনিস কোর্ট, ফিটনেস স্টেশন, সকার ফিল্ড অতিক্রম করতে থাকি। গুগল ম্যাপের সাইন দেখলে গাড়ি থামাই। তারপর আশ্চর্য হয়ে দেখি ড্রাইভারবিহীন গুগল ম্যাপের গাড়ি; গাড়িগুলোর রুফে বসানো হয়েছে নানান রকম যন্ত্রপাতি, সেন্সর আর জিপিএস সিস্টেম। পরীক্ষামূলক এইসব গাড়ি দিয়ে বিভিন্ন জায়গার ‘গুগল স্ট্রিট ভিউ’র ছবি তোলা হয়। ড্রাইভারসহ গুগল ম্যাপের গাড়িও দেখা যায় একপাশে।
ফেরার পথে খুব ইচ্ছা হলো, গুগলের স্মৃতিকে ধরে রাখার। চিন্তার কিছু নেই, গুগল সেই ব্যবস্থাও রেখেছে। মেইন বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় স্যুভেনির শপ; নানান রকম গুগল লোগোসমৃদ্ধ পণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের ডিজাইনে গুগলের মতো বুদ্ধিমত্তার ছাপ। আমরা অনিন্দ্য আনন্দে স্টোরময় চষতে থাকি। ঝটপট অনেকগুলো পণ্য নিয়ে বিল দিতে কাউন্টারে যাই, ক্যাশিয়ার আবারও নির্দয়ের মতো ভিজিটর পাস চায়। আমাদের মন প্রচণ্ড খারাপ হয়, বলি, ভাই, আপনাদের পণ্য আমাদের লাগবে না। এরপরে গুগলে এলে অবশ্যই বাংলাদেশি গুগলজীবী ভাই-বোনদের সন্ধান নিয়ে আসব।
বাইরে টুপ করে কমলা-লাল চেহারা নিয়ে সন্ধ্যা নামে, আমরাও বিদায় নেই। পেছনে তারূণ্য-পাখির পালকের মতো ফেলে যাই গুগল ম্যাপ, অ্যান্ড্রয়েড স্ট্যাচু, টি-রেক্স ডাইনোসর, বিচ ভলিবল, তারুণ্য এবং সৃজনশীলতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
এসএনএস