এই মিলের কথা স্মরণে রেখে অনুমান করা যায় যে, মসজিদটি সম্ভবত আঠারো শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে নির্মিত হয়েছিল। ”
বলছিলাম কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া শাহী মসজিদের কথা।
‘মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার গালগল্প’ ছড়ানোর কারণে এলাকার কৌতূহলী লোকজন দলবেঁধে তা দেখতে আসেন। অবশ্য অনেকে সচেতন মানুষও আসেন পুরনো মসজিদটির স্থাপত্যকলা দেখতে।
অনেকের দাবি মসজিদটি মোগল আমলেরও অনেক আগের। কারো কারো দাবি, প্রায় এক হাজার বছর আগে শাহ সুফী আদারি ইরাক থেকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে এটি নির্মাণ করেন। তবে কুষ্টিয়া জেলা তথ্য-বাতায়নের সূত্রমতে, শাহ সূফী আহমদ আলী ওরফে আদারী মিয়া ছিলেন মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে ঝাউদিয়ার জমিদার। তৎকালীন সময়ে তিনিই নির্মাণ করেন এই ঐতিহাসিক মসজিদটি, যা মোগল শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন।
তবে মসজিদটি নির্মাণ সম্পর্কে এর ইমাম মোকাররম হোসেন বলেন, সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এর প্রবেশদ্বারে লেখা রয়েছে, “এটির বড় পরিচয় মানুষের তৈরি এবং এটা প্রতিষ্ঠিত হয় মোগল সম্রাট আরওঙ্গজেবের শাসনামলে”।
এদিকে মসজিদটিতে প্রার্থনার জন্য নিকটবর্তী এলাকাসহ দূর-দূরান্তের বিভিন্ন মানুষও ছুটে আসেন মসজিদটি নির্মাণকারী জনৈক সুফী সাধকের অনুকম্পা ও সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে। ‘বিশেষ করে শুক্রবার এই মসজিদে দর্শনার্থী এবং প্রার্থনাকারীর সংখ্যা অত্যধিক থাকে’ বলেও জানান মসজিদটির ইমাম।
ঝাউদিয়ায় অবস্থিত এই মসজিদটি মোগল স্থাপত্যরীতির অন্যতম নিদর্শন। এ সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর হক বাংলানিউজকে জানান, এর দেয়ালে লাল ইট আর চুনা পাথরের মিশ্রণের কাজে দিল্লির লাল ইটের স্থাপত্যরীতির প্রভাব রয়েছে। এর দেয়ালগুলোতে রয়েছে ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের কাজ। ছাদের গম্বুজ ও খিলানে এক সময় ছিল সোনালি প্রলেপের কাজ। তবে বর্তমানে তা আর চোখে পড়ে না।
রেলিং প্রাচীরে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর এই মসজিদের মিহরাব এবং গম্বুজের ভেতরের অংশ পাথরের ফুল, চমৎকার লতাপাতা ও আরব্য নকশায় খোদাইকৃত। বাইরে চার কোণায় রয়েছে গোলাকার পার্শ্ববুরুজ। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে পোড়ামাটির নকশার কাজ, যা মোগল ও স্থানীয় শিল্পরীতির নিপুণ সমন্বয়। এছাড়া মসজিদটির মূল স্থাপনার বাইরে রয়েছে বৃহৎ বারান্দা। তবে এই বারান্দার উপর ছাদ থাকলেও তা ভেঙে যাওয়ার ফলে বর্তমানে সেখানে সাধারণ ছাউনি দেওয়া হয়েছে।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালেও একটি করে খিলানপথ থাকলেও বর্তমানে সেগুলিকে ইট দিয়ে তৈরি জালি নকশার সাহায্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও পূর্ব দেওয়ালের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের বাইরের দিকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার শোভিত আয়তাকার প্রক্ষেপণ। যা মিনারগুলি ছাদের প্রাচীর ছাড়িয়ে সোজা উপরে উঠে গেছে। আর এগুলির শীর্ষে রয়েছে কলস নকশার শীর্ষচূড়া শোভিত ছোট ছোট ছত্রী। এছাড়া গম্বুজগুলির শীর্ষে রয়েছে পদ্মকলস নকশার দৃষ্টিনন্দন শীর্ষচূড়া।
সম্পূর্ণ ইটের তৈরী এই মসজিদটির ইমারতের কিছু অংশ ধনুক, বাঁকা কার্নিশ, টেরাকোটা ও খোদাই নকশায় শিল্পীদের নিপুণ হাতে সুসজ্জিত। ভেতরের চমৎকার ফুলেল নকশায় নির্মিত এই মসজিদটিতে পাঁচটি গম্বুজ এবং প্রবেশদ্বারে দুটি মিনার রয়েছে। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি বাংলাদেশে পারস্যের মুরকানা ডিজাইনের আদি নিদর্শন।
‘মসজিদটি নামাজের কাজ ছাড়াও বিচারকার্য এবং সভা পরিচালনার কাজেও ব্যবহৃত হতো’ এমন জনশ্রুতি রয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর রহমান। তবে স্থানটি দর্শনীয় হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন উন্নয়ন না হওয়ার ফলে নষ্ট হচ্ছে এর সৌন্দর্য। ১৯৮০ সাল থেকে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরিচালনা করলেও বর্তমানে নেই এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ।
মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতশত মানুষ ভিড় করেন। অনেকেই এখানে এসে নিজ মনের ইচ্ছা পূরণে মানতও করে থাকেন। দরগায় যেমনটি করা হয়। এছাড়া মসজিদটিকে ঘিরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন কুটির শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনও।
মসজিদটির ভেতরের লাল-সাদার অসাধারণ শৈল্পিক কারুকার্য সহজেই মুগ্ধ করবে যে কোনো দর্শনার্থীকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম