উত্তর কোরিয়ার হাইড্রোজেন বোমার এই পরীক্ষার পর থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে। হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষার কারণে উত্তর কোরিয়ার নিন্দা জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ বহু রাষ্ট্র।
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের দুটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ নামের দুটি আণবিক বোমা ফেলেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিমেষেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় শহর দুটো। প্রাথমিক আঘাতেই প্রাণ হারায় দুই লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে বংশ পরম্পরায় সেই হামলার ভয়বহতার ক্ষত এখনো বহন করছে জাপান।
আণবিক ও পারমাণবিক বোমাতে ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম আর প্লুটোনিয়াম। এদের ভারী নিউক্লিয়াসকে আঘাত করা হয় নিউট্রন দ্বারা। ফলে নিউক্লিয়াস দুই বিভাজিত হয়ে যায়। একে বলে নিউক্লিয়াস বিভাজন বা ফিশন। ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস ভেঙে তৈরি হয় বেরিয়াম আর ক্রিপ্টনের নিউক্লিয়াস। আর সাথে সাথে সৃষ্টি হয় কল্পনাতীত প্রচণ্ড এক তাপশক্তি।
নিউক্লিয়াসের বিভাজনের ফলে কিছু মুক্ত নিউট্রনের জন্ম হয়। একে বলা হয় চেইন রিঅ্যাকশন। এভাবে বোমাটির অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ চলতে থাকে আর বের হয়ে আসে প্রচণ্ড শক্তি। ঘটে আণবিক ও পারমাণবিক বিস্ফোরণ।
বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আণবিক বোমার চেয়েও হাজার গুণ শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা। তবে এদুটি বোমা তৈরি ও কাজ করার পদ্ধতি ভিন্ন।
আণবিক ও পারমাণবিক বোমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন পদ্ধতি। অপরদিকে হাইড্রোজেন বোমা কাজ করে নিউক্লিয়ার ফিউশন পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে দুই বা ততোধিক ক্ষুদ্র পরমাণুকে জুড়ে অনেক বড় ও ভারী পরমাণু বানানো হয়। এতে বেরিয়ে আসে আরও অনেক বেশি শক্তি। তাই এই বোমা পারমাণবিক বোমার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে দুই বা ততোধিক হাইড্রোজেন পরমাণুকে জোড়া হয়, তাই এর নাম ‘হাইড্রোজেন বোমা’।
হাইড্রোজেন বোমার আরেক নাম থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা (ডিভাইস)। কারণ ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’-এর জন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড তাপমাত্রা। দশ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। এ পরিমাণ তাপমাত্রা সৃষ্টির জন্য আবার দরকার হয় নিউক্লিয়ার ফিশন পদ্ধতি। অর্থাৎ ছোট আকৃতির পারমাণবিক বোমা জুড়ে দিতে হয় এতে।
যুদ্ধক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত হাইড্রোজেন বোমা ব্যবহার করেনি কোনো দেশ। প্রথম হাইড্রোজেন বোম বিস্ফোরণ ঘটানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ এনিউইটাকে, ১৯৫২ সালে। এর সক্ষমতা ছিলো ১০০০ কিলোটন। এ পর্যন্ত পরীক্ষা চালানো সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা হচ্ছে ‘জার বোমা’। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বোমাটির পরীক্ষা চালিয়েছিল। রুশ ভাষায় জার অর্থ রাজা, অর্থাৎ বোমার রাজা। যার সক্ষমতা ছিলো ৫০ হাজার কিলোটন। রাশিয়ার এ পরীক্ষার ফলে আশেপাশের দেশ নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের বেসামরিক বাড়িঘরের জানালার কাচ পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি যে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে সেটির সক্ষমতা ১০০ কিলোটন।
অপরদিকে ১৯৪৫ সালে জাপানের নাগাসাকিতে আঘাত হানা বোমা ‘ফ্যাটম্যান’-এর সক্ষমতা ছিল ২১ কিলোটন। অর্থাৎ ফ্যাটম্যানের চেয়েও উত্তর কোরিয়ার বোমাটি পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী। সমশক্তির একটি বোমা বিশ্বের যেকোনো বড় শহরকে চোখের পলকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম।
আর ছোট আকৃতির হাইড্রোজেন বোমা সহজেই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে স্থাপন করা সম্ভব। এখানেই সবচেয়ে ভয়ের কথা। ধারণা করা হয়, ছয় হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে এমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়ার কাছে আছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে চীন ও রাশিয়ার ভূখণ্ড ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় আঘাত হানা পারবে উত্তর কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীনের অস্ত্র ভাণ্ডারে হাইড্রোজেন বোমা রয়েছে। উপমহাদেশের পরমাণু শক্তিধর দু’দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের কাছে হাইড্রোজেন বোমা থাকার দাবি করলেও তার সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৭
এনএইচটি/জেএম