২১শে’র প্রথম শহীদ মিনার বা মেডিকেল কলেজের ব্যারাক তৎকালীন অনেকের কাছে পরিচিত থাকলেও তার কোনোটাই দেখেনি বর্তমান প্রজন্ম। এমনকি সে সময়ের কোনো ছবিও নেই তেমন কারও কাছে।
সেই চেষ্টাই সফল হয়ে ধরা দিয়েছে রাজধানীর ধানমন্ডি ১০ নম্বর সড়কে অবস্থিত ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে’র দেয়ালে। নতুন প্রজন্মের সামনে ৫২’র অমলিন সেই ইতিহাস তুলে ধরতেই এখানে ঠাঁই পেয়েছে মেডিকেল কলেজের ব্যারাক আর প্রথম শহীদ মিনারের ছবি দুটি।
শুধু কি ছবি! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা সংগ্রামীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় এবং তথ্য সংরক্ষিত এ জাদুঘরটিতে। রয়েছে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রায় পাঁচ শতাধিক বইয়ের সংগ্রহশালা। যা এদেশের ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহের এক অনন্য নজির বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভের জন্য এ জাদুঘরটির বিকল্প অন্য কিছুই নেই। এই প্রতিষ্ঠানটি তার জন্মলগ্ন থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাষা এবং ভাষা সৈনিকদের যাবতীয় ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করে আসছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির তথ্য ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ করতে এটি কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
১৯৪৭ সালে ভাষার জন্য রচিত প্রথম গ্রন্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু’ এর মূল কপি সংরক্ষিত এ জাদুঘরে। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রায় চার শতাধিক ভাষা সংগ্রামীর স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও জীবন বৃত্তান্ত। সম্প্রতি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের সংবাদের তথ্য নিয়ে সংকলন করা হয়েছে ‘সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন (১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬)। এখানে বিশিষ্টজনদের ছবি প্রদর্শনের পাশাপাশি মানুষটির জীবনী এবং তার অবদানও মেলে ধরা হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য।
এছাড়া ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা বিভন্ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও বিশ্বের সর্বত্র তুলে ধরা, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও যাবতীয় তথ্যাবলি সংরক্ষণ করে তা দর্শক ও গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিস্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা সহ ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাবতীয় স্থান চিহ্নিতকরণের কাজও এ প্রতিষ্ঠানটি করে যাচ্ছে বলে জানান এম আর মাহবুব।
ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকার মূল কপিসহ সিলেট থেকে প্রকাশিত তৎকালীন ‘নওবেলাল’ পত্রিকা এবং সমকালীন অন্য পত্র-পত্রিকা সংরক্ষিত এখানে। আরও রয়েছে কিশোর ভাষা শহীদ অহিউল্লাহ্র ছবি। যা গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের উদ্যোগে অহিউল্লাহ্র গঠনপ্রকৃতির বিবরণের ভিত্তিতে শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে দিয়ে অঙ্কন করা হয়েছে।
রয়েছে বিভিন্ন ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত ডায়েরি, লাঠি, ঘড়ি, কলম, মেডেলসহ দেয়ালজুড়ে হাজারো ছবি। যেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন স্থাপত্য, সড়ক, মিছিল অন্যতম। আর এ ছবিগুলো যেন গল্প বলে চলে ইতিহাসের। চোখের সামনে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়টাকে।
প্রতিষ্ঠানটির সূচনা সম্পর্কে এর নির্বাহী পরিচালক বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মাতৃভাষার পরিচয়, ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, এ আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাবলি এবং ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণ করে জাতির কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এসব ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসেন ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব। তিনি ২০০৫ সালে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে একটি কক্ষে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু করেন।
২০০৬ সালের ১৯ মার্চ ভাষা সংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজী গোলাম মাহবুবের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষায় তার স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তারই সক্রিয় উদ্যোগে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর।
বর্তমানে ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের আলাদা আলাদা জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ, প্রতিবছর ভাষা সংগ্রামীদের মিলন মেলার আয়োজন, নিয়মিত প্রকাশনা ‘ভাষা’ প্রকাশ, মাতৃভাষা দিবসের উপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, ভাষা সংগ্রামীদের নামে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ, ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সম্মাননা প্রদানের জন্য কাজ করা, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে লাইব্রেরি, গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে সংরক্ষিত দুর্লভ তথ্য ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সংগ্রহের মাধ্যমে আরও বিস্তৃতির কাজ চলছে জাদুঘরে। যা দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরটি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান। এখানে সংরক্ষিত জাতির অমূল্য ও অনন্য সম্পদ। এখান থেকেই যেন আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাবে বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, শেকড় ও অস্তিত্বের কথা। আর তাই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মাইলফলক হিসেবে ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর’ এক অনির্বাণ দীপশিখা হিসেবে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ ও জাতির আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেবে বলেই মনে করেন এদেশের ভাষা সংগ্রামীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
এইচএমএস/এএ