যখনকার কথা বলা হচ্ছে, সে আমলে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার, ইংরেজসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলা ও ভারতের উপকূলে ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু তখনো ভারতের কেন্দ্রে দিল্লিতে মুঘল আর বাংলায় শক্তিশালী শাসক থাকায় বহিরাগত শক্তিগুলো তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয় নি।
যদিও পরবর্তীতে ইংরেজরা বাংলা ও ভারতের কর্তৃত্ব লাভ করে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি আশেপাশের অন্যান্য দেশ দখল করে শাসন-শোষন চালায়, তথাপি আদি শক্তি হিসাবে পর্তুগিজরা আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক-ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানামুখী প্রভাব বিস্তারের চিহ্ণ রেখে গেছে।
লন্ডন ও কলকাতা থেকে ১৯১৯ সালে প্রকাশিত জে.জে.এ. ক্যাম্পস-এর ঐতিহাসিক আকর গ্রন্থ ‘হিস্টরি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল’-এর ভাষ্য মতে, পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল ১৫১৭ সালে পিরেস দ্য অ্যানড্রেডা নামে একজন নৌ-কাপ্তেনকে বাংলায় বাণিজ্য শুরু করার জন্য পাঠান। কিন্তু এই ব্যক্তি পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্যবসায় প্রলুব্ধ হয়ে বাংলায় আর আসেন নি। বরং তিনি পরের বছর, অর্থ্যাৎ ১৫১৮ সালে জোয়াও কোয়েলহো নামে আরেক স্বদেশিকে বাংলায় পাঠান। কোয়েলহো পর্তুগিজদের মধ্যে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম তথা বাংলার এ অঞ্চলে আসেন। একই বছর জোয়াও সিলখেরা নামক আরেকজন পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে চারটি খালি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলে নোঙর করেন।
বাংলার শাসকরা যখন শক্তিশালী ছিল, তখন বহিরাগত পর্তুগিজরা এখানে মোটেও সুবিধা করতে পারে নি। কালক্রমে শাসকের অবক্ষয়ের সুযোগে তারা এ অঞ্চলে বলপ্রয়োগের সুযোগ পায় । বাংলায় আগমনের প্রথম প্রথম ২০/২৫ বছর তারা গোবেচারা বণিকের মতোই আচরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩২-৩৮) যখন শেরশাহ কর্তৃক বারবার আক্রান্ত হতে থাকেন, তখন তিনি সহায়তা লাভের জন্য পর্তুগিজদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাছে ডেকে নেন। তখন বাংলার সুলতান পর্তুগিজদের কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা ছাড়াও চট্টগ্রাম এবং হুগলির নিকটবর্তী সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও বন্দরের শুল্ক আদায়ের কাজ প্রদান করেন। এ সময় পর্তুগিজরা বাংলার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করে।
কিন্তু অচীরেই শের শাহ কর্তৃক বাংলা বিজিত হলে পর্তুগিজদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষমতারও অবসান ঘটে। শের শাহ প্রবর্তিত বাংলায় পাঠান-কররানি সুলতানদের শাসনের অবসান হলে প্রান্তিক জনপদ চট্টগ্রামকে এই অরাজকতার সুযোগে বার্মা-আরাকানের মগ রাজারা দখল করে নেয়। এই সময় মগদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে পর্তুগিজরা কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে বর্তমানের আনোয়ারা উপজেলাধীন দেয়াঙ এলাকায় তাদের বাণিজ্য কুঠি ও গির্জা নির্মাণ করে। দেয়াঙ, যা সমসাময়িক ইউরোপীয় বর্ণনায় দিয়াংগা নামে উল্লেখিত, পরিণত হয় বাংলা তথা ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের প্রধান শহর বা কেন্দ্রস্থল, যাকে তারা বান্ডেল বা বন্দর নামেও অভিহিত করতো। তখন থেকে ১৬৬৬ সালে সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজিত হওয়া পযন্ত সময়কাল, যার পরিধি প্রায়-দেড় শ বছর, দেয়াঙকে কেন্দ্র করে নিম্নবঙ্গে পর্তুগিজ প্রাধান্য ও ক্ষমতা চরমভাবে অক্ষুণ্ন থাকে। এই দেড় শ’ বছরে পর্তুগিজরা একবার বাংলার, আরেকবার মগদের সাথে যোগ দিয়ে স্থানীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার স্বাদ পেতে থাকে। ফলে প্রাথমিক যুগের বণিক মনোবৃত্তিও আর তাদের মধ্যে অটুট থাকে নি। তারা রাজনৈতিক স্বার্থ, ক্ষমতা প্রয়োগ, লুটপাট, শোষণ ইত্যাদি হীন অপরাধ করার মতো সুযোগ ও পরিস্থিতি পেয়ে অবাধে দস্যুবৃত্তির পথ বেছে নেয়। এবং যাবতীয় অপকর্ম ও অপরাধের সীমাহীন তাণ্ডবে তাদের বাংলায় অবস্থানের সময়কালকে চরমভাবে ঘৃণিত ও কলঙ্কিত করে।
যদিও ব্যবসা-বাণিজ্য, কাঁচামাল সংগ্রহ করাই ছিল পর্তুগিজদের আগমনের প্রাথমিক বা মূল লক্ষ্য, তথাপি ইতিহাসের পাতায় তাদের চরম নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন, নিযাতন, দস্যুবৃদ্ধি ও দাস ব্যবসাসহ নানাবিধ কলঙ্কজনক অপরাধের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
জানা যায়, আরাকানের মগ রাজা তাদেরকে বাংলায় লুটতরাজ, নির্যাতন ও দস্যুবৃত্তিতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেন। পর্তুগিজরা হার্মাদ নামে তাদের নৃশংসতার জন্য শুধু চট্টগ্রামেই নয়, পুরো বাংলা ও ভারতেও কুখ্যাতি আর নিন্দা অর্জন করে।
প্রাচীন ইতিহাসবিদ শিহাবউদ্দীন তালিশের রচিত ‘ফতিয়া ইবরিয়া’ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে যে, মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ সালে আরাকানিদের কবল থেকে চট্টগ্রাম বিজয়ের সময় পর্তুগিজদের আরাকান রাজার পক্ষ থেকে সরিয়ে আনেন। শায়েস্তা খান তাদেরকে পুরস্কার ও উচ্চ বেতনের প্রতিশ্রুতি দিলে পর্তুগিজরা মুঘলদের পক্ষাবলম্বন করে। এমন কি, দিল্লির মুঘল সেনাপতি ও যোদ্ধাদের কাছে প্রায়-অচেনা সাগর-পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রাম বিজয়ের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল সম্পর্কে অভিজ্ঞ পর্তুগিজরা শায়েস্তা খানের বাহিনীকে নানাভাবে সাহায্যও করে।
এতে বোঝা যায়, অর্থের বিনিময়ে পর্তুগিজরা যে কোনও কাজ করতেই অভ্যস্ত ছিল। সুবেদার শায়েস্তা খান নাকি পর্তুগিজদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘মগ রাজারা তাদের কত বেতন দেয়?’ উত্তরে তারা বলে যে তাদের কোনও বেতন ছিল না; সারা বাংলা ছিল তাদের জায়গীর, এই অঞ্চল থেকে তারা লুটতরাজ করে প্রচুর ধন-সম্পদ সংগ্রহ করতো।
বাংলাকে তথাকথিত জায়গির রূপে শাসনের বদলে শোষণ চালাতে পর্তুগিজরা মোটেও কুণ্ঠিত ছিল না। এমন কি এই দখলকৃত এলাকা শাসন বা পরিচালনা কাজে তাদের কোনও খরচই ছিল না। পর্তুগিজদের কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দরকার পড়ত না। হিসাব-পত্র রাখা বা খাজনা আদায়েরও কোন বালাই ছিল না।
নিয়ম-শৃঙ্খলার দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্বও তারা নেয় নি। বরং চরম ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে ইচ্ছেমতো লুটপাট করে প্রচুর আয় করে নিত তারা। মানুষ বা সম্পদ, যা খুশি তা-ই তারা নিয়ে যেতে পারত।
মুঘল-পূর্ব আমলে চট্টগ্রামের দখলদার মগ-রাখাইন শাসকরা এদিকে ভ্রূক্ষেপও করতো না। বরং পর্তুগিজদের উস্কে দিয়ে বাংলাকে লুণ্ঠন ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইতো। কোনও কোনও সময় এমনও হয়েছে যে, পর্তুগিজ-মগ আগ্রাসীরা মিলিতভাবে বাংলায় লুণ্ঠন চালাতো।
বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকায় সে সময় বিরাজ করছিল ত্রাসের রাজত্ব। জাহাজে জাহাজে ঘুরে তারা খাদ্য-শস্য-পশু-মানুষ তুলে নিয়ে যেতো। কথিত আছে যে, বাংলার এই নিন্মাঞ্চল থেকে মানুষজন ধরে নিয়ে এই দস্যুরা ইউরোপের বাজারে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিত। পর্তুগিজদের লুটপাট, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদি অনাচারকে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় বলে উল্লেখ করেছেন ইতিহাসের গবেষকরা, বিশেষ করে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম এমনই মনে করেছেন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৭
এমপি/জেডএম