যদিও সেগুলো হুবহু আজকের মানচিত্রের মতো ছিল না, সেগুলো ছিল মানচিত্রের আদিরূপ। তখন মানচিত্রে এতো তথ্য দেওয়ার মতো বুদ্ধি মানুষের মাথায় আসে নি।
মনে করা হয়, মানচিত্রের আদি বা উদ্ভবের স্তরে মানচিত্রের প্রথম ব্যবহার ছিল ভূমি বা জমি চিহ্নিতকরণ ও খাজনা আদায়ের কাজেই। প্রাচীন ব্যাবিলনেও খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে উৎকীর্ণ ফলকের যে মানচিত্র পাওয়া গিয়েছে, তাতে নগরের সহায়-সম্পত্তির নিদের্শনা পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দের একটি মাটির ফলকের মানচিত্রে জমির সীমারেখার সঙ্গে মালিকের নামও দেওয়া হয়েছে। ওই মানচিত্রটিতে নদী, সেচের খালও দেখানো হয়েছে। রাজকীয় সম্পত্তির চারপাশে ঘিরে দেওয়া হয়েছে একটি বৃত্তে।
একই সময়ের মিশরের একটি মানচিত্রে অন্যান্য বিবরণও দেওয়া হয়েছে। প্যাপিরাস বা হাতে তৈরি আদিম কাগজে আঁকা ওই গোটানো মানচিত্রটি আসলে নুবিয়া-অঞ্চলের স্বর্ণক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য আঁকা। সেখানে স্বর্ণক্ষেত্রটি লাল রঙে আঁকা। আমন-এর মন্দির, রাস্তাঘাট ছাড়াও কিছু ঘরবাড়ির সঙ্কেতও দেওয়া হয়েছে এই মানচিত্রে।
শুধু জমিরই নয়, মেসোপোটেমিয়া বা প্রাচীন ইরাকে নগরের মানচিত্রও ছিল। ইউফ্রেটিসের তীরে নিপ্পুর নামে একটি শহরে উনিশ শতকের শেষ দিকে পেনসিলভানিয়ার প্রত্নবিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত এমন একটি মানচিত্রের সন্ধান পান, যাতে গোটা শহরটাকেই দেখানো হয়েছে অঙ্কিত প্রতীকে। নদী, শহরের মাঝখান দিয়ে বহমান খাল, উঁচু জমি, নগরপ্রাচীর, কেন্দ্রীয় উদ্যান, অনেক কিছুই রয়েছে তাতে। এই মানচিত্রটিও মাটির ফলকে আঁচড় কেটে আঁকা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাচীন ব্যাবিলনে মাটির ফলকে আঁচড় কেটে আঁকা হয়েছে খোদ পৃথিবীর মানচিত্র। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের এই ফলকটি গোলাকৃতি এবং সমতল, উভয় ধরনের ছিল। তার চারদিকে সমুদ্র। সমুদ্রে কিছু কাল্পনিক দ্বীপ। এই পৃথিবী আয়তনে ব্যাবিলনের চেয়ে কিঞ্চিত বড়! ব্যাবিলন একটি দীঘল আয়তক্ষেত্র। তার পূর্বে অ্যাসিরিয়া, পশ্চিমে ক্যালডিয়া প্রভৃতি তৎকালীন প্রাচীন সভ্যতা-সমৃদ্ধ জনপদ। মানচিত্রটির আঁকিয়ে নোটস্বরূপ এটাও লিখেছেন যে, ‘এই (পৃথিবীর) মানচিত্রটি গর্বিত ব্যাবিলনিয়ানদের দাম্ভিকতার প্রকাশ’।
বলা বাহুল্য, বক্তব্যটি নিছক একটি দর্শন ও যুক্তিহীন রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর মাত্র। বাস্তব ক্ষেত্রে তথাকথিত পৃথিবীর মানচিত্রে দেওয়াল ঘেরা নিজেদের শহর এলাকাটি মোটামুটি যথাযথ কিন্তু তার বাইরে অজ্ঞানতার ঘোরতর অন্ধকার। ওদের পৃথিবী নিছক এক কল্পলোক; এবং সে কল্পনার দৌঁড়ও বেশি দূর নয়।
প্রাচীন সভ্যতার দাবিদার প্রতিটি জনপদই নানা প্রকরণে ও প্রকৃতিতে মানচিত্র চর্চা করেছে। এ কথা চীন, মিশর, ব্যাবিলন বা মেসোপোটেমিয়ার জন্য যেমন সত্য, তেমনিভাবে সত্য ইনকা, মায়া, সিন্ধু, অ্যাজটেক, গ্রিকো-রোমানদের ক্ষেত্রেও। ব্যাবিলিয়ানদের মতোই শুরু হয়েছিল গ্রিকদের মানচিত্র রচনার ধারা।
ইতিহাসের আদিগুরু গ্রিক দেশের হেরোডোটাস রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি মানচিত্র ব্যবহারের কাহিনী বয়ান করেছেন। সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯-৪৯৪ অব্দের কথা। সে সময়েই সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘আইওনিয়ান বিদ্রোহ’। বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন অ্যারিস্টাগোরাস। নগররাষ্ট্র স্পার্টায় গিয়ে তিনি সেখানকার রাজা কিওমিনেসকে একটি ব্রোঞ্জের ফলক দেখিয়ে বললেন, এটা পৃথিবীর মানচিত্র। মানচিত্রটি তৈরি করেছেন হেকাটায়ুস নামের একজন শিল্পী। বিদ্রোহী নায়ক অ্যারিস্টাগোরাস রাজাকে ফলকটি দেখিয়ে বললেন, এটি গোটা পৃথিবীর মানচিত্র। এই যে দেখা যাচ্ছে আইওনিয়ানদের পরে লাইডিয়ান দেশ। মানচিত্রে একটি পরিসীমা ছিল। ছিল নদী এবং সাগরও। বিদ্রোহী নেতা স্পার্টা-রাজকে আরও বললেন, লাইডিয়ানের পরে কাপ্পাডোডিয়ানসদের রাজ্য। তারপর সিসিলি। এরপর সাইপ্রাস। সর্বত্র ধনদৌলতের বাড়াবাড়ি রকমের ছড়াছড়ি। এক সাইপ্রাস থেকেই পারস্য-রাজ বার্ষিক নজরানা পান পাঁচ শ ট্যালেন্ট। তারপরে দেখা যাচ্ছে আর্মেনিয়ানদের দেশ। সেখানে প্রচুর গো-মহিষাদি রয়েছে। আরও পুবে সিসিয়া ও সুসা নগরী। সেখানেই পারস্য-রাজের অধিষ্ঠান। সেখানেই গচ্ছিত তাঁর কুবেরের ধন-রত্ন ভাণ্ডার। একবার যদি তা দখল করতে পারা যায়, তাহলে দৌলত ও সমৃদ্ধিতে আপনি অনায়াসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন স্বয়ং দেবতাদের সঙ্গে।
সব শুনে স্পার্টার রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, সেখানে পৌঁছাতে কতদিন লাগবে? বিদ্রোহী নায়ক বললেন, পারসিকদের সড়ক ধরে এগোলে তিন মাস। রাজা বেঁকে বসলেন, না, এতো দূরের যাত্রায় আমার দরকার নেই। আজই সূর্য ডোবার আগে তুমি শহর থেকে বিদায় হও। ভেস্তে গেল বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ও উচ্চাশা।
পববর্তী পর্ব
মানচিত্র নিয়ে পাগলামি-খেয়ালি চিন্তা
পূর্ববর্তী পর্ব
মানচিত্রে চৈনিক বাহাদুরি
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭
এমপি/জেডএম