পিনুর মধ্যমা বৃত্তাকারে ঘুরছে রাজনের করতলে। এক পাঁক, দুই পাঁক করে কতবার যে মধ্যমা ঘুরে এলো করতলে, সেদিকে খেয়াল নেই রাজনের।
ঠিক ওই সময়েই কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে আসে দুটি চোখ। সরাসরি তাকায় পিনুর চোখে। পিনু দেখে ওই দুই চোখে উত্তাল ঢেউ। ঢেউকে পাহারা দিয়ে কুলে নিয়ে আসছে সাদা গাঙচিল। দূরে দেখা যাচ্ছে তীর ছেড়ে যাওয়া কিংবা তীরের দিকে আসা জাহাজের মাস্তুল। পিনু বুঝে উঠতে পারছে না জাহাজগুলো কখন তীর ছেড়ে গেলো, তীর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলই বা দেখা যাবে কেন? তাহলে ও নিজে এখন কোথায় আছে? গাঙচিলের ছায়া দেখে ও কোথায় যাচ্ছে। ওর তো সমুদ্রে নামার অভ্যাস নেই। বালুকাবেলায় দাঁড়ায়েই ও গেয়েছে, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’। কখনো সমুদ্রের লবণজল ওর পায়ের মল স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু আজ কেন ও গাঙচিলের সোনালি ছায়ার পিছু নিয়েছে। কোন আগুনস্পর্শের খোঁজে ছুটছে পিনু? সমুদ্রের তলদেশের এমন রঙিন জগত ও কল্পনাও করেনি কখনো। এক্যুরিয়াম সাদা-কালো মোজাইকে গড়ে তোলা সমুদ্রের তলদেশের কথা ভেবে হাসি পাচ্ছে পিনুর। মনে পড়ে রাজন একবার এক্যুরিয়াম পরীক্ষার করতে করতে জানতে চেয়েছিল— আচ্ছা সমুদ্রের নিচে কি এমন মোজাইক পাবো সাদা-কালো? সেদিন হেসে উত্তর দিয়েছিলো পিনু— ডুব দিয়ে দেখে নিস। ইস আজ যদি রাজনটাকে সঙ্গে নেয়া যেত! পিনু যখন গাঙচিলের ছায়ার পিছু নিয়ে সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। তখনই রাজনের করতল ওকে স্পর্শ করলো। রাজনের চোখ মেঘে ঢাকা। সেই মেঘ সাদা রোদ্দুরের কেন? পিনুর মনে প্রশ্ন দেখা দেয়— তাহলে ওর বিদায় যাত্রার যে পায়ের আওয়াজ, তাতে কি রাজনও আনন্দিত! ওর চোখে সেই কি সেই রোদের হাসি? পিচ্ছিল একটা মাছ পিনুকে ডিঙিয়ে গেল। অসভ্যের মতো। একটা প্রাণী আরেকটা প্রাণীকে শরীর ঘেঁষে ডিঙিয়ে গেলে তাকে অসভ্যতাই বলতে হবে। তবে মাছের বাহারী রঙ দেখে মুগ্ধ পিনু। আলো নিভছে, জ্বলছে। অনেক দূর চলে যাবার পরও মাছটিকে দেখা যাচ্ছে। জলজ এমন অনেক কিছুই নজরে পড়ছে পিনুর। যতো দ্রুত তলদেশের দিকে ছুটে যাচ্ছে, ততই সমুদ্রকে ও নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে। স্রোতের এক পাটাতনের সঙ্গে অন্য পাটাতনের মিল নেই। যত নিচে যাওয়া ততই চমকে উঠতে হয়। রাজন কখন যে পিনুর হাতটি নিজের কাছে টেনে নিয়েছিল, টের পায়নি ও। একটি শ্যাওলা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে রাজনের হাত থেকেও নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নেয় পিনু। রাজন হাত সরায় না। পেতে দিয়ে রাখে ওর দিকে। এই প্রথম কালো ডোরাকাটা একটা মাছের দিকে হাত বাড়ায় পিনু। ছাই রঙের ওপর কালো দাগ কাটা মাছটি জলের পৃথিবীতে রূপ ছড়াচ্ছে। মাটির আর কতোটা দেখা হয়েছে? স্বরলিপি চৌহুদ্দির বাইরে ওর দেখার জগৎটা ছোটই ছিল। কিন্তু পৃথিবীটাকে সহজপাঠের মতোই সহজ করতে চেয়েছিল। নিজের প্রাণের গানে সাজাতে চেয়েছিল চারপাশটা। ভেবেছিল যে যত্নে দোপাটি ফুটতো ওদের টবে, উঠোনে, একইভাবে ও স্বপ্নটাও ফোটাতে পারবে। স্বপ্ন তো ফোটেই। কলি হয়ে থাকে, তাকে যত্ন দিয়ে ফোটাতে হয়। পিনু ভেবেছিল ওর মধ্যমাটি কেউ এসে যতনে ধরবে। যার স্পর্শে স্বপ্ন সত্যিই ফুটবে। কেউ একজন এসেছিল ঠিকই, মধ্যমাটি ধরেছিল তাও সত্যি। কিন্তু ওই স্পর্শের প্রতিশ্রুতি সত্য ছিল না। সেই যে মাটির ব্যাংক ভেঙে যাওয়ার মতো, স্বপ্নটা তাকে আর গড়তে চায়নি পিনু। তাই বলে কি স্বপ্নহীন চোখ নিয়ে বেঁচে আছে পিনু? মোটেও তা না। নিজেকে বিন্দু করে বৃত্তাকার মানুষগুলোকে সংগীতের সুরে বাঁধতে চেয়েছিল ও। সবাইকে গাইতে শেখাতে চেয়েছিল আনন্দগান। গাঢ় নীল একটা মাছ মুখ নাড়তে নাড়তে এসে ঠিক পিনুর মুখের সামনে এসে থেমে গেলো। অনবরত মুখ নাড়িয়ে যাচ্ছে অপরিচিত মাছটি। আচ্ছা মাছটিকে তো পরিচিতাও বলা যায়। ওকে এই অতল জলের দুনিয়ায় সখি বানিয়ে দুই-একটা সুখ, দুঃখের কথা বলা যেতে পারে। পিনু নিজেই অবাক হয়ে যায় সুখ-দুঃখ শব্দ দু’টো কতোদিন পর যে ভাবনায় এলো! কি সুখ আর কি দুঃখ, এই অনুভূতিগুলোর স্বাদ কবেই তো পানসে হয়ে গেছে। মাছটি কথা বলে যাচ্ছে, মানে মুখ নাড়িয়ে যাচ্ছে। পিনুর মনে হলো নীলাভ সেই মাছটি জানতে চাচ্ছে— এবার পঁচিশে বৈশাখে কোথায় গাইছো, রবীন্দ্র সরোবর নাকি শিল্পকলায়? পিনুর দীর্ঘশ্বাসে সাগরের ঢেউও বুঝি আনমনা হলো। কতদিন পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠানে গান করা হয় না। সহশিল্পীরা গান করে, সেসব ফুটেজ বা ছবি রাতে টিভিতে বা পারদিন পত্রিকায় দেখতে হয় ওকে। কিন্তু একটা সময় ছিল এই দুইদিনের পরদিন পত্রিকায় পিনুর ছবি থাকবেই। এই ভাবনাগুলো এসে ওর মধ্যমাতে জমা হচ্ছে। ভাবনটি থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না ও। তাই মধ্যমা বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জমিন হিসেবে পেয়েছে রাজনের করতল। রাজনকে যেন পিনু জিজ্ঞাসা করছে এবারের পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে কোথায় কী আয়োজন হচ্ছে। একবার তো ওর বলতেই ইচ্ছে হলো— রাজন আমাকে বেলী এনে দিবি? খোঁপায় গুঁজে রবীন্দ্র সরোবরে যাবো। হয়তো ওর মধ্যমা তাই বললো রাজনের করতলের কাছে। কিন্তু রাজন কি তা বুঝতে পারলো? লাল রঙের জলজ লতা এসে পিনুর গলা জড়িয়ে ধরলো। ওকে আরো দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতলের দিকে। মধ্যরাতে শহরের রাস্তায় অমবশ্যা, পূর্ণিমা কিংবা ঝড়ের রাতে চা খাওয়ার অভ্যাসটা রাজনের পুরনো। আজও রাজন সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে পরপর তিন কাপ চা খেয়ে নিলো। এমনটা করে কখনো কখনো রাজন। মন খুব ভালো থাকলে যখন ওর উড়ে যেতে ইচ্ছে হয় তখন, আবার খারাপ হওয়া মনটাকে যখন পাখির বাসায় লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে, তখনও ওকে এই পাগলামীর নেশায় ধরে। চায়ের দাম মিটিয়ে যখন হাঁটতে শুরু করবে, তখনই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে— পিনুর চোখ স্থির হয়ে গেছে। সোজা ছাদের দিকে তাকানো। তাকিয়ে আছে কিনা বলা যাচ্ছে না। চোখের মণিটা নড়ছে না। তার হাতের আঙুলগুলো বরফ শীতল। ঠোঁট দুটো জোড়া লেগে আছে। কোনোভাবেই তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে উদ্বেগ— পিনু আছে তো? কিছু ভেবে নাকি না ভেবেই রাজন উত্তর দেয়— আছে। আরো দেরি হবে পৌঁছতে। টেলিফোনের ও-প্রান্ত রাজনের উত্তর বুঝতে না পেরে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে বলে— দেরি কেন, এখনই চলে আয় না! রাজন ভাবনার একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই বলে— আসতে হবে না। তারপর মোবাইল অফ করে দেয়।
ও হাঁটতে থাকে। রাস্তার দুই পাশের সোডিয়াম বাতি বিবর্ণ করেছে জারুল, কৃষ্ণচূড়া আরা কণকচূড়াকে। রাজন নিজের দিকেও তাকায়। তাকিয়ে হাসে ওর রঙও বদলে গেছে। জলজ লতাটি বড্ড নাছোড়। পিনু এখন খানিকটা বিরক্তও। জলের দুনিয়াটা কি একদিনেই দেখিয়ে ছাড়বে নাকি! পিনুর মনে পড়লো মহানবীর মেরাজ যাত্রার কথা। পিনু তো নগন্য একটা প্রাণী মাত্র, এই জলের দুনিয়ায় যে কত প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কাছে নিজেকে তুচ্ছই মনে হচ্ছে। সেই তুচ্ছ প্রাণীকে নিয়ে কোনো আলোকিত যাত্রা হতেই পারে না। পাশ থেকে হলুদ রঙের একটা মাছ কথা বলে উঠলো। আসলে মাছটি কেবল ঠোঁট নাড়িয়েছে। সেই ঠোঁট নাড়ানোটাই যেন পড়ে নিলো পিনু। সব মানুষেরই অনন্ত যাত্রার যাত্রী হতে হয়। তুমিও হবে। পিনুরও ঠোঁট নড়ে— তাহলে এখানে নিয়ে আসা কেন? হলুদ মাছটির ঠোঁট নড়ে— পথ চিনিয়ে দিয়ে হলো। পরে যখন আসতে হবে তখন ভয় পাবে না। চোখে, ঠোঁটে আতঙ্ক ফুটে উঠবে না। চেনা পথে যাচ্ছো বলে একধরনের প্রশান্তি থাকবে মনে। সেই প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়বো তোমার চোখে মুখে। পিনুর ঠোঁট নড়ে— তাতে আমার কি লাভ হবে? হলুদ মাছের ঠোঁট নড়ে— সারা জীবনে তুমি কতটা লাভ-ক্ষতির হিসেব করেছো বলো? নিজের জন্য কোন অঙ্কই তো ছিল না। তোমার মুখের প্রশান্তি তোমার প্রিয়জন আর পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে— তুমি এক আনন্দ যাত্রার যাত্রী হয়েছো। রাজন বাড়ি ফিরে বারান্দাতেই কাটিয়ে দিয়েছে রাত। নিস্তব্ধ শহর কিভাবে জেগে উঠে, তা দেখা বা উপভোগ করাটাও ওর নেশা। কাল রাত থেকে রাজন পুরনো নেশাগুলোতে আসক্ত হয়ে উঠছে। বারান্দাতে বসেও পুরো রাতে সাবাড় করেছে চার কাপ কফি। এখন ঢেঁকুর উঠতে শুরু করেছে। সকালের আকাশটা আজ পোশাক পাল্টে ফেলেছে। আজ তার আবরণ নীল। থোকা থোকা সাদা মেঘ। বৈশাখের সকালটাকে শরতের সকালের মতোই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। বাতাসটাও কেমন মায়ায় জড়িয়ে নেয়ার মতো। বারান্দা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। নিমফুলগুলো সেই মায়াতেই যেন ভিজে উঠেছে। নিম গাছে বাসা বাঁধা চড়ুইও আড়মোড়া ভাঙলো মাত্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাজনের বারান্দার গ্রিলে এসে বসেছে। রাজনকে ওরা আপন ভাবে। প্রায়ই পাশে এসে বসে। নানা ঢঙে নেচে আবার উড়াল দেয়। কাল রাতে অফ করা মোবাইলের কথা মনে পড়লো রাজনের। তাইতো সারারাতে একবারের জন্য বেজে উঠলো না মোবাইল। অন করে দেখে কোনো কল আসেনি। ম্যাসেজও নেই। তাহলে পিনুর দিক থেকেও কোনো খবর হয়নি? রাজন উঠে ঘরের ভেতরে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢাললো। পরপর দুই গ্লাস পানি খেলো থেমে থেমে। ভাবনার মধ্যে পিনুই আছে প্রতিবার। কেউ কিছু জানালো না। স্থির হয়ে গেছিল চোখ, তারপর…। নিজেই হাসপাতালে পিনুর মোবাইলে ফোন করতে নেয়। ফোনটা পিনুর পাশেই রাখা। চারদিন আগেও পিনু্ই ফোন ধরেছে। ফোন ধরে চিরাচরিত ভাবে ‘হ্যা রে রাজন’ বলে কথা শুরু করতো। রাজনের ফোন যাবার আগেই হাসপাতাল থেকে ফোন এলো। উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই ও প্রান্ত থেকে জানাচ্ছে— পিনু উঠে বসেছে। কথা বলছে। কিন্তু কী বলছে বুঝতে পারছি না আমরা। অসংলগ্ন সব কথা। সাগর-মাছ আজগুবি সব কথা। রাজন পিনুকে চাইলো। পিনুর কানে ফোন ধরিয়ে দিলে রাজন বলে— কেমন হলো ঘুরে বেড়ানো? পিনু জানায়— খুব ভালো। রাজন আবার বলে আর ওই হলুদ মাছটা? পিনু হেসে উত্তর দেয়— একদম তোর মতো রে রাজন!
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৪