ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

একুশের গল্প

প্রতীক্ষা | যুথিকা বড়য়া (পর্ব-১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
প্রতীক্ষা | যুথিকা বড়য়া (পর্ব-১) বাংলানিউজ

প্রতীক্ষা 
যুথিকা বড়য়া 
একুশের গল্প (পর্ব-১)

১.
হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় মমতার। তন্দ্রা জড়ানো চোখে ধড়ফড় করে ওঠে।

থর থর করে কাঁপছে সারাশরীর। বুক ধুক্ ধুক্ করে উঠছে। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য ঠাহরই করতে পারছিল না, স্বপ্ন না বাস্তব। চোখ মেলে দেখে চারিদিকে। তখনও আবছা অন্ধকার বাইরে। দিগন্তের পূর্ব প্রান্তরজুড়ে ঊষার প্রথম স্নিগ্ধ, নির্মল ও কোমল ক্ষীণ আলোর আভায় ক্রমশ একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে। চারদিক কী নীরব, নিঝুম, শান্ত পরিবেশ।  

পিছন ফিরতেই দেখে, খোকনের ঘরে আলো জ্বলছে। ওর ঘরের দরজাটা খোলা। পাশে বাথরুমে ঝরনার মতো ঝির ঝির করে পাইপ কলের জল পড়ছে শোনা যাচ্ছে। ‘খোকা স্নান করছে বোধহয়। কিন্তু এতো ভোরে! খোকা আজ যাচ্ছে কোথায়!’ 

স্বগতোক্তি করতে করতে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে মমতা। দ্রুত গিয়ে ঢোকে খোকনের ঘরে। ঢুকেই নজরে পড়ে, বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্পের আড়ালে কালো রঙের একটি কাপড়ের পোটলা পড়ে আছে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, কোনো জন্তু-জানোয়ার বুঝি জানালা দিয়ে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পের পাশে ঘুপচি মেরে বসে আছে।

খানিকটা বিস্ময় নিয়ে কাছে এগিয়ে যায় মমতা। গিয়ে দেখে, কোনো জীব-জন্তু নয়, কাপড়ের পোটলাও নয়। সেটি একটি লেদারের ব্যাগ। ব্যাগটি মাঝারি আকারের। বাইরে থেকে ফুলে উঠেছে। মনে হচ্ছে, ভর্তি কোনো জিনিস আছে ব্যাগটিতে। কিন্তু কী হতে পারে! আশ্চর্য্য, খোকার ঘরে এতোবড় লেদারের ব্যাগ এলো কোত্থেকে! আগে তো কখনও দেখিনি! বললো মনে মনে।  

স্বাভাবিক কারণেই ব্যাগটি খুলে দেখবার বড্ড কৌতূহল হয় মমতার। সম্বরণ করতে পারে না। কিন্তু ব্যাগটি হাতে নিতেই চাপাকণ্ঠে খোকন গর্জে ওঠে, ‘মা, তুমি এ ঘরে, কী করছো? ঘুম থেকে উঠে এলে কেন? সর্বনাশ, ওটা ধোরো না, বিপদ ঘটে যেতে পারে। শিগগির রেখে দাও’! 

বলতে বলতে বাথরুম থেকে দ্রুত এগিয়ে আসে খোকন। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে একরকম ছোঁ মেরে মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে টি-টেবিলের নিচে রেখে দেয়।  

অপ্রস্তুত মমতা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলো। আচমকা খোকনের এ ধরনের বিহেভ কল্পনাই করতে পারেনি। অত্যার্শ্চয্যজনকভাবে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। খোকনের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ও’যে কিছু একটা লুকোচ্ছে, সেটা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হলো। কিন্তু সহজ-সরল মমতা তার পরক্ষণেই ভাবে, কী আর হবে! বন্ধু-বান্ধবের কোনো ব্যক্তিগত জিনিস হবে হয়তো! কিন্তু মমতা আদৌ জানে না যে, ওই ব্যাগটিতে কী আছে। মায়ের অজান্তে খোকন আজ যাচ্ছে কোথায়? আর সেই সর্বনাশা জিনিসটাই বা কী?

স্বাভাবিক কণ্ঠে খোকন বললো, ‘খামাখা ঘুম থেকে উঠে এলে। আজ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে জরুরি একটা মিটিং আছে। খুব আর্লি-মর্নিংয়ে সেখানে অ্যাটেন্ড করতে হবে। যাও যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো যাও! মাত্র সাড়ে পাঁচটা বাজে এখন’!
 
এমন স্বাভাবিক গলায় বললো, যেনো কিছু হয়নি। এদিকে মনে মনে ভাবে, নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে মা। এখন ওকে ওয়াচ্ করছে বোধহয়।  

নজর এড়ায় না মমতার। লক্ষ্য করলো, মুখখানা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেলো খোকনের। গভীর তন্ময় হয়ে কী যেনো ভাবছে। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। বিড় বিড় করে কী যেনো বলছে ও।  

এ অবস্থায় মায়ের মন কিছুতেই স্বস্তি পায় না। কারণ অনুসন্ধানে প্রচণ্ড উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় খোকনের মুখের দিকে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে।  

চোখে চোখ পড়তেই হেসে খোকন বললো, ‘তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো, যাও! খামাখা টেনশন নিচ্ছো! আমায় এক্ষুণিই রেডি হতে হবে’!

মায়ের সঙ্গে খোকন কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর নজর ওই ব্যাগটির দিকে। কেমন অস্থির অস্থির ভাব। মনে হচ্ছে, মাকে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।  

খটকা লাগলো মমতার। কেমন সন্দেহজনক মনে হলো। অসন্তোষ গলায় বললো, ‘খোকা, তুই অমন ছটফট করছিস কেন? আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বলতো, এই সাতসকালে তুই কোন রাজকার্যে যাচ্ছিস? তখন থেকে লক্ষ্য করছি, কেমন উদাস, অন্যমনস্কভাব। হয়েছে কী তোর! বলি কিসের এতো চিন্তা তোর? কার জন্যে? তোদের ইউনিভার্সিটিতে মিটিং আছে বলছিস, এতো কিসের জরুরি মিটিংট’?

সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করে খোকন বললো, ‘ও হো, কী মুশকিল, বলছি না গিয়ে শুয়ে পড়তে। যাও তো, যাও। ওসব তুমি বুঝবে না’।

খানিকটা নরম হয়ে পড়ে মমতা। গলার আওয়াজ মোলায়েম করে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘মায়ের কাছে কিছু লুকোস নে বাবা। কোথায় যাচ্ছিস, কী করছিস, মাকে বলবি নে! তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল! হ্যাঁ রে, ওই কালো ব্যাগের মধ্যে কী আছে? খুব দামী জিনিস বুঝি’!

খোকন নিরুত্তর। পড়ে যায় বিপাকে। মায়ের জেরায় একবার পড়ে গেলে জবাবদিহি করতে করতে ওর প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব যাবে মাটি হয়ে। এই ভেবে মাকে উপেক্ষা করে হঠাৎ আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে। বাধ্যগত ছেলের মতো খুব মার্জিত হয়ে বলে, ‘এতো ভাবনার কী আছে মা! তেমন মারাত্মক কিছু নয়। ওটা আমার এক বন্ধুর। কদিনের জন্য গচ্ছিত রেখেছিল। কিন্তু তুমি ঘুম থেকে উঠে এলে কেন? আমি কী দুধের খোকা’?

হাতের মাসল ফুলিয়ে বলে, ‘আমি এখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র, হাট্টা-গোট্টা তরুণ যুবক। সামান্য একটা তুচ্ছ বিষয়কে এতো সিরিয়াসভাবে নিচ্ছো কেন বুঝি না। আমারও তো একটা প্রাইভেসি থাকতে পারে, না কি’।

ভ্রু-যুগল কুঁচকে চেয়ে থাকে মমতা। ভিতরে ভিতরে খুব চটে যায়। কিছু বলবার ব্যাকুলতায় ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠতেই মাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে খোকন। কনভিন্স করার চেষ্টা করে। সহাস্যে বললো, ‘রিল্যাক্স মাদার রিল্যাক্স, ডোন্ট ওরি! কাম মন! আচ্ছা, ঘুম থেকে উঠেই পড়েছ যখন ফটাফট্ এক কাপ গরমাগরম চা করে নিয়ে এসো দেখি! শরীরটা একটু ঝর ঝরে হয়ে যাক!’

কথা না বাড়িয়ে মমতা তক্ষুণিই চলে যায় রান্নাঘরে। এরমধ্যে খোকন দ্রুত জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নেয়। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে রান্নাঘরের দিকে একবার গলা টেনে দেখে কী যেনো ভাবলো। টি-টেবিলের নিচ থেকে ব্যাগটি হাতে নিয়ে পা টিপে নিঃশব্দে দ্রুত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।  

তার পরক্ষণেই প্লেটে করে চা, বিস্কুট নিয়ে আসে মমতা। ঘরে ঢুকে দেখে, খোকন ঘরে নেই। বাথরুমে গলা টেনে দেখলো, সেখানেও নেই। মায়ের অগোচরে কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, টেরই পায়নি। হঠাৎ নজরে পড়ে, টি-টেবিলের নিচে রাখা কালো ব্যাগটিও নেই।  

মমতা তৎক্ষণাৎ চাপা উত্তেজনায় স্বগতোক্তি করে ওঠে, ‘আশ্চর্য্য, মায়ের অলক্ষ্যে দানা-পানি মুখে না দিয়েই খোকন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো! যাওয়ার পথে মাকে একবার দর্শনও দিলো না! নিশ্চয়ই মায়ের অমতে কিছু একটা করতে যাচ্ছে। কিন্তু মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে ওই কালো ব্যাগে করে কী নিয়ে গেলো খোকন? কোথায় নিয়ে গেলো? কাকেই বা দিতে গেলো’?
 
সাধারণত মায়ের মন সবর্দা কু-ই গায়। হাজার প্রশ্নের ভিড় জমে ওঠে মমতার। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। নানান দুঃশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় ওকে ক্রমশ আষ্টে-পৃষ্ঠে ঘিরে ধরে। একটা মুহূর্তও আর স্বস্তি পায় না।

মমতা অতি সহজ সরল, সেকেলে নারী। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। স্বামী বিয়োগের পর একদম নরম হয়ে গেছে। কোনো বিষয়ে তেমন গভীরভাবে ভাবতে পারে না। গুরুত্ব দেয় না। মাথা ঘামায় না। কিন্তু আজ কাণ্ডজ্ঞানহীন খোকনের অসন্তোষজনক আচরণে ক্ষোভে দুঃখে-ফেটে পড়লেও তন্ময় হয়ে ডুবে যায় এক অভাবনীয় ভাবনার অতল সাগরে। ওকে ধাওয়া করে এক অনিশ্চিত মোহনার দিকে। কী অপরিসীম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় অতিবাহিত হতে থাকে মমতার এক একটা মুহূর্ত।  

স্বামীর অকাল মৃত্যুতে হারিয়ে গেছে মনের শক্তি, আত্মবিশ্বাস। সামান্য কারণেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মন-মানসিকতা দুর্বল হয়ে পড়ে। সর্বক্ষণ নিজের জগতে বাস করে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুরকূলের ভিটে-বাড়িসহ অল্প কিছু ধানি জমি ছিলো, তাতেই শাক-সব্জি, আনাচপাতির চাষ করে। ফসলের অধিকাংশই বাজারে বিক্রি করে। সম্প্রতি হাঁস-মুরগির পোল্ট্রিও খুলেছে। সেখান থেকেও বেশকিছু টাকা আসে। সব মিলিয়ে উপার্জন যা হয়, তা দিয়ে মা-ছেলে দু’জনের দিব্যি স্বচ্ছলভাবে চলে যায়। টাকা পয়সা নিয়ে কখনও ভাবতে হয় না। একমাত্র খোকনকে নিয়েই যতো চিন্তা-ভাবনা, আশা-ভরসা। অকাল বৈধব্যে একাকী নিঃসঙ্গতায় শোক-দুঃখ-বেদনা ভুলে, প্রাত্যহিক জীবনের পারিপার্শ্বিক কোন্দল-বিবাদ-বিচ্ছেদ-বেদনার কালো ছায়া থেকে সরে এসে, এতোকাল বুকে আগলে রেখে নিজের মনের মতো করে খোকনকে মানুষ করেছিল কি এই জন্যে? এইদিন দেখার জন্যে? মায়ের মনে কষ্ট দিতে বিবেকে এতোটুকু বাঁধলো না খোকার? দুঃশ্চিন্তা ভাবনায় মায়ের শরীরের কী হাল হবে, সেকথা একবারও ভাবলো না! মায়ের কথা একবারও ভাবলো না! কিন্তু খোকা আজ গেলো কোথায়?

চলবে...

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ