ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

জলে ভাসা জীবন | শেখর কান্তি রায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৭ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৭
জলে ভাসা জীবন | শেখর কান্তি রায় জলে ভাসা জীবন

রহিম-জাহানারা গাজী দম্পতির যাপিত জীবনের অনেকটাই এখন নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই সম্পর্ক দুশ্চিন্তার। জোয়ারের পানি বাড়লে দুশ্চিন্তাও বাড়ে।

বরষাকালের পূর্ণিমায় নদীর জোয়ার স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে আরও বড় হলে দুশ্চিন্তাও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দিনের জোয়ারের চেয়ে রাতের জোয়ারের ভয় বেশি।

জোয়ারের পানিতে  উঠান, ক্ষেত ডুবে যায়। রাত জেগে জোয়ারের বাড়তি-কমতি’র হিসাব করে রহিম-জাহানারা গাজী। উঠান থেকে জোয়ারের পানি নামতে শুরু করলে তবেই নিশ্চিন্ত হয়। রহিম গাজীদের জীবনের এই পরিবর্তন  খুব বেশিদিন আগের নয়।  

একসময় রহিম গাজীদের অবস্থা ভালো ছিলো। গোলপাতার ছাউনি আর মাটির দেয়ালের বসত ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, পুকুর, বিঘা দশেক ধানী জমি- এই সব মিলিয়ে স্বচ্ছলতায় দিন কাটতো। এক ফসলি জমির ধান দিয়েই সারা বছরের যাবতীয় খরচ চলে যেতো। এর বাইরে পেশা বলতে সুন্দরবনে মাছ, মধু, কাঠ সংগ্রহ করা। তবে সেটা পেশা না বলে বলা যায় নেশাই ছিলো। “কোনো কিছুর অভাব ছিলো না তখন। উত্তর থেকে ধান কাটার মজুর আসতো, আমরা তাদের বলতাম পরবাসী। আর এখন আমরাই ধান কাটতে উত্তরে যাই,’’ কথাগুলো বলতে বলতে উদাস হয়ে যায় রহিম গাজী। কারণ, এইরকম এক ধান কাটার মৌসুমে আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে জ্যৈষ্ঠ মাসে রহিম গাজী এবং তার পাড়ার তালেব, কিরণ, স্বপন ও আরও কয়েকজন মিলে উত্তরের জেলা ফরিদপুরে ধান কাটতে গিয়েছিল। সেখানেই এক দুপুরে মোবাইল ফোনে বাড়ি থেকে খবর আসে ঘূর্ণিঝড় আইলা’য় সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। সবাই যেনো এক্ষুনি চলে আসে।  

ঘূর্ণিঝড় রহিম গাজীদের কাছে নতুন কিছু নয়। ১৯৮৮ সালের বন্যায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি সব ভেঙে গিয়েছিল। নদী ভাঙনে বেড়িবাঁধের বাইরে বিঘা দুয়েক জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আবার নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছে। কিন্তু এবারের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে অন্যগুলোর তুলনা চলে না। রহিম গাজী বাড়ি দেখে চিনতে পারে না। সবগুলো ঘর ভেঙে পড়েছে। জোয়ারের পানিতে পুকুর, বিল সব একাকার। প্রতিবেশীরা সবাই বাড়ি সংলগ্ন বেড়ি বাঁধের উপর ছাপড়া ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। তার পরিবারও নতুন এই বসতির অংশ। রহিম গাজীদের বেড়িবাঁধের নতুন জীবনে কতো নতুন মানুষের আনাগোণা। বিভিন্ন সংস্থার মানুষ। নামের তালিকা তৈরি করে। রহিম গাজীর মধ্যবিত্ত মানসিকতায় নতুন এই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীদেরও এই নতুন পরিবেশ থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে রহিম গাজী। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরামর্শ করে দিন চলার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। “কাকা আয়-রোজগারের কোন উপায় হলো। এভাবে তো বেশিদিন চলবে না। ধান কাটার মজুরি যে কয় মণ ধান এনেছিলাম উত্তর থেকে তাও তো শেষের দিকে। সবাই তো ত্রাণ এর জন্য চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে যাচ্ছে চলো আমরাও যাই” তালেব, কিরণদের এই প্রশ্ন, পরামর্শের কোনো জবাব দিতে পারে না রহিম গাজী। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছ থেকে রহিম গাজী সবসময় একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। কয়েকদিন ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েও তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি রহিম গাজী।

প্রতিবেশীদের সবাই যখন বিভিন্ন ত্রাণ সংগ্রহ করছে তখন এই কাজে রহিম গাজীর ব্যর্থতায় স্ত্রী জাহানারা বেশ বিরক্ত। সংসারের যাবতীয় কাজ তো তাকেই করতে হয়। খাওয়ার পানি থেকে জ্বালানি সবকিছু সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যাবেলা বেড়িবাঁধের উপর দোকানঘরে চা এর আড্ডায় সারাদিনের কার্যক্রমের হিসাব খুলে বসে পাড়া প্রতিবেশীরা। রহিম গাজীও সেই আড্ডায়  নিয়মিত অংশ নেয়। এই আসরে অবশ্য তার কিছুটা কদর বাড়ে। পুরানো দিনের কথা তার কাছ থেকে সবাই শুনতে চায়। রহিম গাজী বলে, “আমাদের  পূর্ব পুরুষরা এখানে এসেছে তা প্রায় দেড়শো বছর হবে। সুন্দরবন আবাদ করে জমি বসতযোগ্য, আবাদযোগ্য করেছে। নতুন জমিতে তখন প্রচুর ফসল হতো। তখন তো বেড়ি বাঁধ ছিলো না। ধান রোপণের জন্য অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হতো। আমরা বলতাম অষ্টমাসী, ষষ্ঠমাসী বাঁধ। পলি পড়ে জমি উর্বর হতো। মানুষের মনে আনন্দ ছিলো। কতো মেলা হতো। তারপর তো ৬০ সালের দিকে বেড়িবাঁধ হলো। সবাই বলতো ওয়াপদা বাঁধ। রাস্তাঘাট  ভালো হলো। দুই ফসলের চাষও হলো অনেক জায়গায়। তারপর তো একটু একটু করে সব পাল্টাতে শুরু করলো। চারপাশে লোনা পানিতে ভরে গেল।  চিংড়ি চাষ শুরু হলো। ধানী জমিতে আর ধান আগের মতো হলো না”, এই পর্যন্ত বলে আর বলতে পারে না রহিম গাজী। গলা ভারী হয়ে আসে। রহিমের অসমাপ্ত কথা শেষ করে তার প্রতিবেশী সনাতন মন্ডল, বলে, সেই থেকে তো আমাদের দুর্ভোগের শুরু। আমরা জমিধারীরা আস্তে আস্তে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। যে বাঁধ দেওয়া হলো আমাদের রক্ষা করার জন্য সেই বাঁধটা আমরা ঠিকমতো দেখাশুনা করে রাখলাম না। বাঁধটা দুর্বল হয়ে গেলো।  নদীও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর বড় জোয়ারের পানিতে তো এখন বেড়িবাঁধ ডুবে যাওয়ার অবস্থা। শেষের এই পরিবর্তনটা অবশ্য যুবকদের কাছে অপরিচিত নয়। সন্ধ্যাবেলার এই আসর থেকে একে একে সবাই বাড়ি ফিরে যায়। শুধু রহিম আর তার বয়সী সনাতন ও আরও দু’-একজন কিছুটা সময় কাটিয়ে তারপর বাড়ি  ফেরে।  

দিন-রাত মিলে দুইবার জোয়ারের পানিতে বাড়ির উঠান, ক্ষেত সব ডুবে যায়। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। রহিম গাজীরা রাত জেগে মাছ ধরে। সারা রাতের সংগৃহীত মাছ পরদিন বিক্রি করে সংসার চালায়। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন চলবে? নতুন বাঁধের স্বপ্ন দেখে সবাই। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। সন্ধ্যার আসরে নতুন বাঁধের খবর শোনায় রহিম গাজীদের ওয়ার্ডের মেম্বার করিম সানা। বড় কর্মকর্তারা কয়েক দফা এলাকা দেখে গিয়েছে। শীতকালে বাঁধের কাজ শুরু হবে। নতুন বাঁধের পরিকল্পনা নিয়েও সন্ধ্যার চা এর আসরে আলোচনা হয়। করিম সানার কাছ  কাছ থেকে নতুন বাঁধের যে পরিকল্পনা সবাই জানতে পারে তাতে দেখা যায় গ্রামের শেষ প্রান্তের দশটি পরিবার নতুন বাঁধের বাইরে পড়েছে। নদী ভাঙন থেকে নতুন বাঁধ রক্ষা করার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রহিম গাজী  কী করবে বুঝতে পারে না। নদী ভাঙনে জমি, ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট আছে তার সবটুকুই নতুন বাঁধের বাইরে পড়েছে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার, বড় কর্মকর্তাদের কাছে বেশ কয়েকবার গিয়েও কোনো লাভ  হয়নি। রহিম গাজীর প্রতিবেশীদের বেশ কয়েকজন অন্য জায়গায়  চলে গিয়েছে। কিন্তু রহিম গাজী বাপ-দাদার ভিটা মাটির মায়ায় জোয়ার-ভাটার জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যায়। এ সংগ্রামের শেষ কোথায় তা জানা নেই রহিম গাজীর।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ