বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সম্প্রতি সময়ের কথা বেশ ভালোভাবেই স্মরণ করা যায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে দেশের ফুটবলের ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশের ফুটবলের সাফল্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। যার নেপথ্যে রয়েছেন এক ইংলিশ ফুটবল কোচ, নাম তার জেমি ডে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব নেন অখ্যাত এই কোচ। কিন্তু অখ্যাত এই কোচের ছোঁয়াতেই বাংলাদেশের ফুটবল পাল্টে গেছে অনেকটা জাদুর মতো। বড় বড় দলের সঙ্গে এখন বাংলাদেশ সমান তালে লড়তে শিখছে। এই পুরো কৃতিত্বই তার। ইংল্যান্ডের পঞ্চম স্তরের ক্লাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা দিয়েই বাংলাদেশের ফুটবল পাল্টে দিয়েছেন তিনি।
করোনার কারণে বাংলাদেশর ফুটবল এখন বন্ধ। কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বের ম্যাচও পিছিয়ে গেছে। তাই দেশের আন্তর্জাতিক ফুটবল আপাতত বন্ধ। সঙ্গত কারণেই ক্লাব ফুটবলও নেই। তাই ব্যস্ততা না থাকায় নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ। অবসর সময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন জেমি ডে। জানিয়েছেন বাংলাদেশে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা, দেশের ফুটবলের খুঁটিনাটি বিয়ষ নিয়ে কথা বলেছন জাতীয় দলের এই ইংলিশ কোচ।
বাংলাদেশে কোচিং অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জেমি ডে বলেন, ‘বাংলাদেশ কাজ করার অভিজ্ঞতা এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ। বেশ ভালো সময় কেটেছে এই দুই বছর। ভালো সময় খারাপ সময় দুটো অভিজ্ঞতাই হয়েছে। তবে এই দুই বছরে বেশ ইতিবাচক দিক গুলোই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। ফুটবলারদের বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে। ভালো টুর্নামেন্ট খেলেছি যার ফলাফল ভালো ছিল। তবে এখন পর্যন্ত আমি বেশ উপভোগ করেছি বাংলাদেশে কোচিং। অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে এখন পর্যন্ত ভালো। ’
২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর ভুটানের কাছে ৩-১ গোলের হারের পর বাংলাদেশের ফুটবল চলে যায় অন্ধকার জগতে। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসিত হয় বাংলাদেশ। প্রত্যাশার আর প্রাপ্তির মধ্যে ছিল বিস্তর ফাঁরাক। বাংলাদেশের ফুটবল হয়ে যায় মৃতপ্রায়। মাঝে ইংলিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ড চেষ্টা করেও ফিরে গেছেন। এরপরই জেমি ডে’র হাত ধরেই দেশের মৃতপ্রায় ফুটবলে আবারও প্রাণ ফিরে পায়। ব্যর্থতার তলানিতে পৌঁছানো দলই এখন প্রতিপক্ষের সমীহ পায়।
বাংলাদেশ দলের পরিবর্তনের নিয়ে জেমি ডে বলেন, ‘প্রত্যেকটা দলেই খারাপ সময় আসবে, এটা অবধারিত এবং এটার খেলার অংশ। সবসময় প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল আপনি পাবেন না। তাই বলে ভেঙে পড়া চলবে না। আমি সেটাই চেষ্টা করেছি। ফুটবলারদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা তৈরি করার চেষ্টা করেছি যে চাইলেই লড়াই করা যায়, ঘুড়ে দাঁড়ানো যায়। সেটাই কাজে দিয়েছে। এখন কিন্তু বাংলাদেশ লড়াই করতে পারে। পুরো ৯০ মিনিট সমান তালে খেলতে পারে। এটাই বাংলোদেশ দলের বড় পরিবর্তন। ম্যাচ খেলার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতাটা বাড়বে তখন এমনিতেই জয় আসবে। তবে সেটার জন্য সময় দরকার। আগামী দুই বছর এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবো। ’
একটা দেশের ফুটবল উন্নত করতে হলে সেই দেশের ক্লাব ফুটবলের উন্নতি করা প্রয়োজন। ক্লাব ফুটবলে আরও পেশাদারি মনোভাব তৈরি করা প্রয়োজন। জেমি ডে মনে করেন এই জায়গাটাতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। আরও অনেক বেশি পেশাদারি মনভোব আনতে হবে ক্লাবগুলোকে।
জেমি ডে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের তিন থেকে চারটি ক্লাবের মধ্যে আমি পেশাদারি মনভাব দেখিছি, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে আমি বসুন্ধরা কিংসের কথা বলবো। তারা বেশ ভালোভাবেই পেশাদারিত্বের সঙ্গেই মাঠে নেমেছে, সেই চেষ্টা করছে। তাদের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা রয়েছে, দেশের সকল ফুটবল ক্লাবকে এটা অনুসরণ করা উচিত। সব ক্লাবের একটা একাডেমি থাকা উচিৎ যেখান থেকে ফুটবলাররা উঠে আসবে। সেটা করতে পারলে আসলে দেশের ফুটবলেরই উন্নতি হবে। ’
তবে শুধুমাত্র ক্লাব নয় ফুটবল ফেডারেশনকেও এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সব জায়গাতে যেন ফুটবল খেলা হয় সেটা নজরদারি করা প্রয়োজন। শুধু মাত্র ক্লাবের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই হবে না। ফুটবলের উন্নতি করতে হলে ও ভালো ফুটবলার তৈরি করতে হলে ভালো সুযোগ সুবিধা দিতে হবে, যাতে করে তরুণ খেলোয়াড়রা ফুটবল শিখতে পারে।
জেমি ডে বলেন, ‘ফুটবলের উন্নয়ন করতে হলে ফেডারেশনকে আগে নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশের প্রতিটা জেলাতে যেন ফুটবল মাঠে গড়ায়। তরুণ ফুটবলারদের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে যাতে করে তারা ফুটবল খেলা শিখতে পারে, তরুণ বয়সেই যাতে স্কিল ভালোভাবে রপ্ত করে, যাতে পরিপক্ক হতে পারে। অনুশীলনের সুযোগ দিতে হবে। এই কাজগুলো ফেডারশনের নিয়মিত করা উচিৎ। ’
বাংলাদেশের ফুটবল পরিবর্তনে কি করণীয়, কিভাবে দেশের ফুটবল সামনের দিকে এগোবে, ফুটবলারদের লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ এমন প্রশ্নে এই ইংলিশ কোচের পরামর্শ তৃণমূল থেকেই ভালো কোচের অধীনে নিয়মিত অনুশীলন করা। ফুটবলারদের প্রতি কোচের পরামর্শ জাতীয় দলের পরফরম্যান্স দিয়ে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবে খেলাই যেন লক্ষ্য হয়। কঠিন হলেও কোচের এই পরামর্শ কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে বাংলাদেশ বলেই এই পরামর্শটা বেশ হাস্যকর হতে পারে। তবে লক্ষ্য যদি সেটা হয় তবে মন্দ কিসের!
জেমি ডে বলেন, ‘ফুটবলারদের ছোট থেকেই ভালো কোচের অধীনে অনুশীল করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। নিয়ম মেনে স্কিল ট্রেনিং করে ১০-১২ বছর এর পেছনেই থাকো, সাফল্য আসবেই। আমি মনেকরি ফুটবলারদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলা। এটা এখন সম্ভব না। আজ থেকে শুরু করলে ১০-১৫ বছর পর সেটা সম্ভব। ফুটবলারদের স্বপ্ন হওয়া উচিত দেশেরে বাইরে খেলা। ’
তবে এতো দূর চিন্তা না করে এখন দেশের ফুটবলের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাই ফুটবলারদের প্রধান লক্ষ্য উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০
আরএআর/এমএমএস