নোয়াখালী: সরকারি নানা উদ্যোগ ও সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সেবা দানে গাফিলতি ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যকে পুঁজি করে নোয়াখালীতে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েই চলেছে। জেলা শহর মাইজদী যেন এক হাসপাতালের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
এরপরও প্রকৃত চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ রযেছে। সেবা নয়, এখানে বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এসব হাসপাতাল আবার তিলকে তাল বানিয়ে এক দিকে যেমন রোগীদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে, অন্য দিকে ভুল ও অপচিকিৎসার ফাঁদে পড়ে অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন।
সরজমিন দেখা যায়, ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালকে কেন্দ্র করে জেলা শহর মাইজদীর হাসপাতাল রোডের দুই পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি তুলনামূলক অনেক বেশি, চিকিৎসকরা দালাল চক্র ও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে চুক্তিভিত্তিক পল্লী চিকিৎসকদের পাঠানো রোগীদের থেকে কমিশন দিতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব হাসপতালের অধিকাংশই রোগী ভর্তি করে শুধুমাত্র আবাসন সুবিধা দিয়ে লাখ লাখ টাকার বিল হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময়ই রোগীদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারি সুবিধা দিতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসাসেবার ওপর ভরসা করতে না পেরে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে যাচ্ছেন, আর সেখানে অতিরিক্ত খরচ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না। দুই-একটি ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারও ঠিকমতো নেই।
আরেকটি অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৫০ শয্যার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। এছাড়া জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। ফলে রোগী অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য জনবল কম থাকায় রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে মেঝে ও বারান্দায় বিছানা পেতে থাকতে হচ্ছে। তখন অনেক রোগীকে যেতে হয় ব্যয়বহুল বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায়।
এমন অবস্থায় দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে কিছু চিকিৎসক উন্নতমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলে রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য পাঠাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ভেতরে বাইরে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন। যদিও দালাল চক্রকে প্রতিরোধ করতে কয়েকবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়েছে, তবে সেটিও এখন আর চলমান নেই।
নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল একটি, আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি হাসপাতাল নয়টি, কমিউনিটি ক্লিনিক ৩০০টি, সিএইচসিপি’র সংখ্যা ২৭১টি, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক একটি, শুধুমাত্র মাইজদী ও বেগমগঞ্জে স্কুল হেলথ ক্লিনিক দু’টি, প্রত্যন্ত এলাকা চর আলগীতে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল একটি। জেলায় সরকারি চিকিৎসকের মোট পদ সংখ্যা ২৫৯টি। এর মধ্যে এখনো ৯৭টি পদ শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ ২৩৬টি, শূন্য রয়েছে ৪২টি।
অন্য দিকে বৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ১৮২টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১২৮টি, ডেন্টাল ক্লিনিক রয়েছে ১২টি। এছাড়া জেলার আনাচে-কানাচে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আরও শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলার সাধারণ সম্পাদক আবু নাছের মঞ্জু জানান, নোয়াখালী জেলায় এখনো একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। জেলার জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ গ্রামে বসবাস করলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান এখনও সীমিত। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে জেলা শহর মাইজদীতে অবস্থিত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালই জরুরি চিকিৎসাসেবার একমাত্র স্থান। এখান থেকে দালাল চক্র নিমূর্ল এবং ডাক্তার ও নার্সদের সমন্বয়ে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে সাধারণ মানুষ আর বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হবেন না। আর্থিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা পাবেন।
নারী অধিকার জোটের সভানেত্রী লায়লা পারভিন জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে অন্তঃসত্ত্বা ও তার স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে স্বাভাবিক প্রসব না করিয়ে সিজার করে একজন মাকে পঙ্গু করে দেয়। ফলে অনেক সময় মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এর থেকে রক্ষার জন্য সরকার যদি জেলার সব ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিত করে, তাহলে সাধারণ মানুষ অদক্ষ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে দূরে রাখতে পারেন। তাহলে এক দিকে মা ও শিশুর ঝুঁকি কমে আসবে, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বাণিজ্যের পাশাপাশি সঠিক সেবা দিতে বাধ্য হবে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, বিশাল জনগোষ্ঠীর জেলা নোয়াখালীতে শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বৈধ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছে। এ রকম অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। আর যেসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন না নিয়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান চালিয়ে সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছি।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমরা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। প্রতিটি মাসিক সমন্বয় সভায় জেলায় স্বাস্থ্যসেবার সাফল্য-ব্যর্থতা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এরই আলোকে জেলার স্বাস্থ্যসেবায় অনিয়ম প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দালালদের প্রতিরোধ করতে কয়েকবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়েছে। আগামীতেও এমন অভিযান চলবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জেলায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, শূন্য পদে চিকিৎসক, নার্স ও টেশনিশিয়ানসহ জনবল দ্রুত নিয়োগ করতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালুর ব্যবস্থাসহ অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে হবে এবং যা আছে, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাণিজ্য পরাজিত হয়ে সেবাটাই প্রধান হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২২
এসআই